সোহেল গোলদার আট বছর ধরে ইতালির ভেনিস শহরে একটি রেস্তোরাঁয় কাজ করছেন। তিনি শরীয়তপুরের নড়িয়া পৌরসভার বৈশাখীপাড়া এলাকার বাসিন্দা। গত ৮ জানুয়ারি ছুটিতে দেশে আসেন। ছুটিতে এসেই করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে আটকে পড়েছেন তিনি। মার্চে তাঁর ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। আট মাস ধরেও ফিরতে না পেরে হাতের সঞ্চয় ফুরিয়ে এখন অর্থকষ্টে ভুগছেন।
সোহেল গোলদার যখন দেশে আসেন, তখনো ইতালিতে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়াবহতা দেখা যায়নি। চীনের উহান শহরে সবে সংক্রমণ শুরু হয়। তিনি দেশে আসার ঠিক দুই মাস পর মার্চে বাংলাদেশেও সংক্রমণ ছড়ায়। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে দুই মাস বন্ধ থাকার পর জুনে ইতালির সঙ্গে বাংলাদেশের ফ্লাইট চলাচল শুরু হয়। তবে ৬ জুলাই বাংলাদেশ থেকে ইতালির রোমে যাওয়া একটি ফ্লাইটের বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি যাত্রীর দেহে সংক্রমণ শনাক্ত হলে বাংলাদেশ থেকে সব ধরনের ফ্লাইট বাতিলের ঘোষণা দেয় ইতালি। এ নিষেধাজ্ঞা এখন ৫ অক্টোবর পর্যন্ত বহাল।
সোহেল গোলদার প্রথম আলোকে বলেন, ইতালির সঙ্গে বিমান যোগাযোগ চালু হলে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটের টিকিট কাটেন। তবে তাঁর ফ্লাইটের সময় আসার আগেই ইতালির সঙ্গে বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
দুশ্চিন্তা নিয়ে সোহেল বলেন, ‘গ্রামে স্ত্রী-সন্তান, মা–বাবাসহ ৬ সদস্য থাকেন। সংসারের নানা খরচ চালাতে হচ্ছে। আট মাস ধরে কোনো আয় নেই। বসে বসে সঞ্চয়ের টাকা খরচ করেছি, এখন তা–ও শেষ হয়ে গেছে। দুই মাস ধরে ঋণ করে চলছি। কবে ইতালি ফিরে যেতে পারব, তা বুঝতে পারছি না। ফিরে গিয়ে আগের কাজ পাব কি না, তার নিশ্চয়তাও নেই।’
শরীয়তপুরে সোহেলের মতো আরও অনেকে প্রবাসে কর্মস্থলে ফিরতে না পরে দেশে আটকে পড়েছেন। অর্থকষ্টে ভুগছেন।
শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, শরীয়তপুরের ছয় উপজেলার ১ লাখ ১৫ হাজার বাসিন্দা প্রবাসে থাকেন। এর ৭০ শতাংশ থাকেন ইতালিতে। প্রতিবছর গড়ে ৭০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আসে শরীয়তপুরে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে প্রবাসীদের পাঠানো টাকার অঙ্ক কমে গেছে। জানুয়ারি থেকে ১৮ হাজার প্রবাসী শরীয়তপুরে ফিরে এসেছেন।
শরীয়তপুর সদরের পালং এলাকার বাসিন্দা রুবেল খলিফাও ইতালির ভেনিস শহরে থাকেন। গত নভেম্বরে ছুটি কাটাতে দেশে আসেন। মার্চে তাঁর ফেরার কথা ছিল। ইতালি-বাংলাদেশ ফ্লাইট চালু হলে তিনি ৯২ হাজার টাকা দিয়ে টিকিট কাটেন। তাঁর ফ্লাইট ছিল ৯ জুলাই। এর আগেই ফ্লাইট চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
রুবেল খলিফা বলেন, ‘১০ মাস ধরে দেশে আছি। বসে খেলে রাজার গোলাও ফুরিয়ে যায়। এখন হাতে টাকা নেই, স্বজনদের কাছ থেকে ঋণ করে চলতে হচ্ছে। ইতালি ফিরে আগের কাজ পাব কি না, তা বুঝতে পারছি না। দেশে যে কোনো কাজ শুরু করব, সেই ভরসাও পাই না। জানি না আমাদের এমন কষ্টের জীবন কবে শেষ হবে।’
নড়িয়ার শুভগ্রামের বাসিন্দা খোরশেদ ব্যাপারী একসময় ইতালির রাজধানী রোমে থাকতেন। ২০১৮ সালে পদ্মার ভাঙনে তাঁদের ফসলি জমি ও বসতবাড়ি বিলীন হয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে দেশে ফিরে আসেন। পারিবারিক নানা সংকটের কারণে আর ইতালি ফিরে যেতে পারেননি। নড়িয়ার বাজারে কাপড় ও তৈরি পোশাক বিক্রির দোকান খুলে বসেছেন। তাঁর চার ভাই, দুই ভাতিজা, দুই ভাগনে ও দুই জামাতা পরিবারের মোট ১০ জন ইতালি থাকেন। ছুটি কাটাতে ১০ জনই দেশে এসে আটকে পড়েছেন। তাঁদের প্রত্যেককে টাকা দিয়ে সহায়তা করতে গিয়ে খোরশেদ ব্যাপারীর দোকানটি বিক্রি করে দিতে হয়েছে।
খোরশেদ ব্যাপারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই সংকটময় মুহূর্তে স্বজনদের পাশে দাঁড়াতে হয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে দোকানটি বিক্রি করে দিতে হয়েছে। স্বজনেরা ইতালি ফিরে যেতে পারলে আবার সুদিন ফিরে আসবে আশায় আছি।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নড়িয়ার বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের ব্যাংকে গত জানুয়ারি পর্যন্ত প্রতি মাসে গড়ে ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকা প্রবাসীদের লেনদেন হতো। এখন তা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। আটকে পড়া অনেক প্রবাসী ও তাঁদের স্বজনেরা ব্যাংক থেকে সঞ্চয় তুলে নিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা অনেক সংকটের মধ্যে পড়েছেন বুঝতে পারছি।’
এ ব্যাপারে শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক কাজী আবু তাহের প্রথম আলোকে বলেন, অনেক প্রবাসী ছুটি কাটাতে এসে আটকে পড়েছেন। অনেকে অর্থনৈতিক সংকটেও পড়েছেন। প্রবাসীরা যেকোনোভাবে সহায়তা চাইলে প্রশাসন তা দেবে।