ছোট্ট গোলাকার হাওয়াই মেশিনের হাতল একতালে অনবরত চেপে যাচ্ছে একটি হাত। অপর হাতে চলছে উনুনে রেঙ্গুন বাঁশের গায়ে সেঁক দেওয়া। বাঁকা বাঁশ দুই হাতের প্রচণ্ড চাপে সোজা করে আলাউদ্দিন তার গায়ে সেঁটে দিচ্ছেন কালো-ধূসর ছাপ। ৫০ বছরের পুরোনো পারিবারিক ঐতিহ্য তাঁদের ছিপকোড়ো (আঞ্চলিক নাম) তৈরি করা। আলাউদ্দিন এ পেশায় আছেন ৩০ বছর।
গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার ডালেশহর গ্রামে ছিপকোড়ো তৈরির এমন কর্মযজ্ঞ চলে দিনরাত। গ্রামের ১৫টি পরিবার ছিপকোড়ো তৈরি করে। স্থানীয় বাজারে দেয়। এরপর দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করা হয়। বাঁশ সংগ্রহ করা হয় স্থানীয় পর্যায়ে।
গত বৃহস্পতিবার ডালেশহর গ্রামে গিয়ে বর্ষীয়ান আলাউদ্দিনের দেখা পাওয়া গেল। সড়কের পাশে উন্মুক্ত ঘরে ছিপকোড়ো তৈরি করছিলেন তিনি। মন দিয়ে কাজ করছিলেন তিনি, সঙ্গে তাঁর ছেলে হুমায়ুন কবির। থরে থরে সাজানো তৈরি ছিপকোড়ো। শ্রীপুরসহ আশপাশের বিভিন্ন কারখানায় ছোট কোড়োগুলো সরবরাহ করেন তাঁরা।
আলাউদ্দিন বাবার কাছ থেকে কাজ শিখেছেন। তাঁর কাছ থেকে শিখে গেছেন হুমায়ুন কবির। বাপ-ব্যাটা দুজনে মন দিয়ে কাজ করে দৈনিক ১০০টি ছিপকোড়ো তৈরি করতে পারেন। আলাউদ্দিন জানান, একেকটা ছিপ বা কোড়ো তৈরি করতে বেশ সময় লাগে। পরিশ্রম করতে হয়। আগুনের তাপে বাঁশ কিছুটা নরম হলে সেটাকে সজোরে ও কৌশলে চাপ দিয়ে সোজা করতে হয়। তারপর বাঁশে কালো রং আনতে তেল দিতে হয়। আগুনের তাপের মধ্যে সারা দিন বসে কাজ করতে হয়। হুমায়ুন কবির বলেন, বাঁশগুলো পাইকারি দরে কিনে সেগুলো রোদে শুকাতে হয়। তার আগে বাঁশ এনে সেগুলো থেকে ডালপালা ছাড়াতে হয়। এ কাজে গ্রামের অনেক নারী দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কাজ করেন। তাঁরা প্রতিটি বাঁশ নিখুঁতভাবে ছেঁটে তাপ দেওয়ার উপযোগী করে দেন।
একই গ্রামের শাহাবুদ্দিন জানান, প্রতিটি ছিপকোড়ো পাইকারি ২০-৫০ টাকায় বিক্রি হয়। কোড়ো দৈর্ঘ্যভেদে বিভিন্ন দামের হয়ে থাকে। নৌকা বাঁধা, বেড়া দেওয়ার কাজে কোড়ো ব্যবহার করা হয়। একসঙ্গে অনেকগুলো ছিপকোড়ো জড়ো করে ট্রাকে করে ঢাকায় পাঠানো হয়। পরে সেখান থেকে বিভিন্ন পাইকারের হাত হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে যায়। শৌখিন মাছশিকারিরা চাইলে তাঁদের কাছ থেকে ফরমাশ দিয়ে ইচ্ছেমতো মাপের ছিপ তৈরি করিয়ে নিতে পারেন।
এই কাজের জন্য ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা হলে গ্রামে অনেক বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব। এ কাজে নারীরাও সরাসরি যুক্ত।
এ বিষয়ে শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ শামসুল আরেফীন বলেন, ‘এই কাজ গ্রামবাসীর জন্য লাভজনক হলে তাদের নিয়ে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে এর প্রসারের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করব।’