অন্তঃসত্ত্বা হওয়া থেকে সন্তান প্রসব—নবজাতক চুরির জন্য সুপরিকল্পিতভাবে ‘নাটক’ সাজিয়েছিলেন এক নারী। হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ড থেকে একটি নবজাতক কন্যাশিশু চুরিতে সফলও হয়েছিলেন। কিন্তু সেই নাটক মঞ্চস্থ করতে গিয়েই ‘চিত্রনাট্যে’র কিছুটা ফাঁক থেকে ধরা পড়ে গেছেন তিনি। চুরি হওয়ার ২৭ ঘণ্টা পর অবশেষে নবজাতকটি ফিরে এসেছে মায়ের কোলে।
নবজাতক উদ্ধার ও চোরকে আটকের এ ঘটনাটি ঘটেছে আজ শনিবার দুপুরে রাজশাহী নগরে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ড থেকে চুরির প্রায় ২৭ ঘণ্টা পরে শিশুটি আজ বেলা একটার দিকে উদ্ধার হয়। রাজশাহীর রানীনগর পল্টুর বস্তি থেকে গোয়েন্দা পুলিশ নবজাতকটি উদ্ধার করেছে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বাচ্চাটিকে যখন ফিরে পান তার মা, আনন্দাশ্রুর সঙ্গে বারবার সন্তানকে চুমু খাওয়ার দৃশ্যে উপস্থিত সবাই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।
গতকাল শুক্রবার সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ৯টার মধ্যে হাসপাতালের ২৩ নম্বর ওয়ার্ড থেকে নবজাতক কন্যাশিশুটি চুরির ঘটনা ঘটে। ওই নবজাতকের মায়ের নাম শিল্পী রানী দাস ওরফে কমলি। বাবার নাম মাসুম রবি দাস। রাজশাহী নগরের আইডি বাগানপাড়া এলাকায় তাঁদের বাড়ি। পেশায় মাসুম রবি মুচি। চুরির তিন দিন আগে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে এই কন্যাশিশুর জন্ম হয়। তার নাম রাখা হয় লক্ষ্মী। এটি তাঁদের প্রথম সন্তান।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ড থেকে চুরির প্রায় ২৭ ঘণ্টা পরে শিশুটি আজ বেলা একটার দিকে উদ্ধার হয়।
সিটি করপোরেশনের দৈনিক মজুরিভিত্তিক কর্মচারী মো. সজীবের স্ত্রী মোসা. মৌসুমী বেগম (২৩) বেগম বাচ্চাটি চুরি করেছিলেন। শিশুটির জন্মের পর থেকেই তাকে চুরির উদ্দেশ্যে মৌসুমী বেগম হাসপাতালের ওই ওয়ার্ডে অন্য রোগীর স্বজন হিসেবে যাতায়াত শুরু করেন। চুরির আগে আগে শিশুটির মা কিছুটা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন। তখনই সুযোগ বুঝে মৌসুমী শিশুটিকে কোলে তুলে নেন। তবে সঙ্গে সঙ্গেই মা শিল্পী রানী তা টের পান। তিনি ওই নারীকে বলেন, ‘আপনার হাত ঠান্ডা। বাচ্চা নেবেন না।’ এ কথা বলতে বলতেই মৌসুমী বাচ্চা নিয়ে বেরিয়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে শিশুটির মা বাইরে গিয়ে তাঁর নাগাল পাননি।
ঘটনার পর নগরের রাজপাড়া থানার পুলিশ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে তদন্ত শুরু করে। কিন্তু পুলিশ হাসপাতালের সিসিটিভি ক্যামেরা থেকে কোনো ফুটেজ পায়নি। আজ উদ্ধারের পর বেলা তিনটায় রাজশাহী মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে পুলিশ বাচ্চাটি উদ্ধারের কাহিনি বর্ণনা করে। এ সময় রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিক, গোয়েন্দা শাখার উপপুলিশ কমিশনার আবু আহাম্মদ আল মামুনসহ অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
উপপরিদর্শক ছয়ফুল ইসলাম উদ্ধারকারী দলে ছিলেন। তিনি বলেন, সজীব ও মৌসুমী বেগমের আট বছর আগে বিয়ে হয়েছে। তাঁদের কোনো বাচ্চা হয়নি। এরপর মৌসুমী বেগম হাসপাতাল থেকে নবজাতক চুরির পরিকল্পনা করেন। তিনি গর্ভবতী হয়েছেন এটা মহল্লাবাসীকে বোঝানোর জন্য কাপড় বেঁধে পেট উঁচু করে থাকতেন। তিনি যে বাচ্চা প্রসব করেছেন, এ ঘটনার সাক্ষী রাখতে হাসপাতাল থেকে বাড়ি যাওয়ার সময় রিকশা থেকে পড়ে যাওয়ার ভান করেন, যাতে মহল্লার লোকজন তাঁকে নবজাতকসহ হাসপাতাল থেকে ফিরতে দেখে। এ সময় লোকজন এগিয়ে এসে তাঁকে রিকশায় তুলে দেন। তবে তখন বাচ্চার গা পরিষ্কার দেখে এবং মৌসুমী বেগমের কাপড়চোপড়েও কোনো রক্তের দাগ নেই দেখে মহল্লার মানুষের মধ্যে কানাকানি শুরু হয়।
হাসপাতালের ছাড়পত্র ছাড়া শিশু ওয়ার্ড থেকে বাচ্চা নিয়ে বের হওয়ার নিয়ম নেই সত্য। এখন কীভাবে শিশুটি নিয়ে মেয়েটি বের হলো, বিষয়টি তদন্ত করে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।শামীম ইয়াজদানী, পরিচালক, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে
ওই মহল্লায় থাকেন রাজশাহী মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কনস্টেবল মাহফিজুর রহমান। তিনিই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিষয়টি জানান। সঙ্গে সঙ্গে সহকারী পুলিশ কমিশনার রাকিবুল ইসলাম একদল পুলিশ নিয়ে ওই বাসায় যান। মৌসুমী বেগম প্রথমে পুলিশকে পাত্তা দেননি। বাচ্চাটা তাঁর নিজের বলে দাবি করেন। একপর্যায়ে জেরার মুখে তাঁর স্বামী সজীব বাচ্চা চুরির কথা স্বীকার করেন। গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে ধরে নিয়ে আসার পরে সজীব ঝরঝর করে কাঁদছিলেন। তিনি বলেন, তিনি গরিব মানুষ। চাকরিটাও গেল। এখন জেলে যেতে হবে। তবে স্ত্রী মৌসুমী বেগমের চোখে পানি ছিল না। তিনি বলেন, তাঁর স্বামী কিছু জানেন না। তিনি একাই পরিকল্পনা করে এই কাজ করেছেন।
তবে স্বামীকে মামলা থেকে বাদ দেওয়া হবে কি না, জানতে চাইলে উপপুলিশ কমিশনার আবু আহাম্মদ আল মামুন বলেন, তিনি (সজীব) ঘটনার সঙ্গে জড়িত না থাকলে বাচ্চা দেখেই পুলিশকে খবর দিতেন। তিনি তা করেননি। এখন তাঁদের দুজনের বিরুদ্ধে শিশু আইনে মামলা হবে। বাচ্চা চুরি হওয়ার পর বাচ্চাটির মা-বাবা হাসপাতাল ছেড়ে যাননি। তাঁরা বাচ্চাটি উদ্ধারের আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষা করতে থাকেন। আজ বিকেলে বাচ্চাকে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেওয়ার সময় হাসপাতালের অন্যান্য রোগীর স্বজনেরা বাচ্চাটিকে একনজর দেখার জন্য ভিড় করতে থাকেন। মা অশ্রুসজল চোখে বাচ্চাকে বারবার চুমু খাচ্ছিলেন।
হাসপাতালের ছাড়পত্র ছাড়া শিশু ওয়ার্ড থেকে বাচ্চা নিয়ে বের হওয়ার নিয়ম নেই। তাহলে কীভাবে বাচ্চাটি চুরি হলো জানতে চাইলে পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, নিয়ম ঠিকই আছে। এখন কীভাবে শিশুটি নিয়ে মেয়েটি বের হলো, বিষয়টি তাঁরা তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।
এর আগে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২২ নম্বর ওয়ার্ড থেকে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে একটি নবজাতক চুরি হয়েছিল। ৪ দিন পরে ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি শিশুটি উদ্ধার করা হয়েছিল। ২০১৭ সালের ১৯ জানুয়ারি নগরের একটি মাতৃসদন কেন্দ্র থেকে একটি বাচ্চা চুরি হয়। ২৮ জানুয়ারি সে বাচ্চাটিও উদ্ধার হয়।