‘রাইতের খাওয়াদাওয়া শেষ কইরা ঘুমাতে যাই ১১টার দিক। রাত আড়াইটা–তিনটার দিকে মানুষের চিৎকার–চেঁচামেচিতে ঘুম ভাইঙ্গা যায়। উঠে ঘরের মেঝেতে পা দিতে গিয়া দেখি পানিতে ডুইবা গেছে ঘর। এরপর মরি–বাঁচি কইরা বাড়ির বেবাক লোক বাইর হইয়া আসি।’
গতকাল বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে বন্যার পানিতে মুহূর্তের মধ্যে তলিয়ে যায় ফরিদপুর শহরের বর্ধিত পৌরসভার ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের অধীনে ভাজনডাঙ্গা মহল্লা। ওই মহল্লার বাসিন্দা গৃহবধূ হালিমা বেগম (৪২) রাতের সেই বর্ণনাই তুলে ধরেন এ প্রতিবেদকের কাছে। আজ শুক্রবার তাঁর সঙ্গে কথা হয় বেলা সাড়ে ১১টার দিকে।
হালিমা বেগম এখন আশ্রয় নিয়েছেন ফরিদপুর-চরভদ্রাসন আঞ্চলিক সড়কের পাশে। বাঁশ ও টিন দিয়ে একটি ছাপরা তুলছিলেন তিনি।
শুধু হালিমা বেগমই নন, ভাজনডাঙ্গা এলাকায় ওই মহল্লার শত শত পরিবারের সদস্যদের তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে উদ্ভ্রান্তের মতো ছোটাছুটি করতে দেখা যায়। গতকাল সকাল ১০টার দিকে ভুইয়াবাড়ি ঘাট এলাকায় পদ্মা নদীর পাড় ভেঙে ফরিদপুর পৌর এলাকায় পানি ঢুকতে শুরু করে। এলাকাবাসী বালির বস্তা ফেলে সে পানি ঠেকাতে পারেনি।
ওই এলাকার বাসিন্দা জাহিদুল ইসলাম (৪৯) বলেন, পানি ঠেকানোর জন্য পৌরসভা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে ধরনা দিয়েও কোনো কাজ হয়নি। ফাটলটি প্রথমে ১০ ফুট দৈর্ঘ্যের ছিল। বিকেলের মধ্যেই বেড়ে ২০০ ফুটের কাছাকাছি চলে যায়। রাতের মধ্যে তলিয়ে যায় ভাজঙ্গডাঙ্গা মহল্লার সহস্রাধিক বাড়ি।
আজ ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কেউ রিকশা–ভ্যানে করে মালপত্র সরিয়ে নিয়ে আত্মীয়ের বাড়িতে যাচ্ছেন, কেউবা সড়কের পাশে কিংবা অস্থায়ী কোনো জায়গায় বাঁশ–টিন দিয়ে ছাপরা তুলছেন।
ভাজনডাঙ্গা এলাকার নাইম শেখ বলেন, ‘এক রাইতে সব তলায় যাবে, এইডা এর আগে কখনো দেখি নাই। মানুষজন জিনিসপত্র সরানোর সময়ও পায়নি। অনেকের তোশক–বালিশ ভিইজা গেছে।’
একই এলাকার বীথি বেগম বলেন, ‘পানিতে ঘর ডুবইবা গেছে। এখন ভাবছি কোথায় গিয়ে মাথাটা গুঁজব। কোনো কূলকিনারা পাচ্চি না।’
ফরিদপুরে গত ২৪ ঘণ্টায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। পদ্মার পানি বিপৎসীমার ৯৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় পানি বেড়েছে ১৫ সেন্টিমিটার।
পানিতে ডুবে গেছে ফরিদপুর-চরভদ্রাসন আঞ্চলিক সড়কের চারটি জায়গায় অন্তত তিন শ মিটার অংশ। এর মধ্যে সদরের আলীয়াবাদ ইউনিয়নের সাদীপুর উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে অংশে পানি হাঁটুসমান।
একই ইউনিয়নের গদাধরডাঙ্গী এলাকায় শেখ আবদুলের বাড়ির সামনে চরভদ্রাসন-ফরিদপুর সড়কের অন্তত ৫০ মিটার অংশ ধরে ফাটল দেখা দিয়েছে। ওই সড়কটির পশ্চিম পাশে গভীর গর্তবিশিষ্ট একটি পুকুর থাকায় যেকোনো মুহূর্তে সড়কের ওই অংশ ধসে যেতে পারে।
ওই এলাকার বাসিন্দা ন্যাশন্যাল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী নাজমুল হাসান ফাহিন (২১) বলেন, আজ সকাল আটটার দিকে ওই সড়কে ফাটল দেখা দেয়। পরে এলাকাবাসী নিজেদের উদ্যোগে সড়কের ওই জায়গায় চলাচল বন্ধ করে দিয়ে বালির বস্তা ফেলে মেরামত কাজ শুরু করে। পরে এ কাজে সড়ক বিভাগের লোকজন এসে যোগ দেন।
ফরিদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সুলতান মাহমুদ বলেন, ফরিদপুর শহরে ও তার আশপাশে পদ্মা নদীর তীর ব্লক দিয়ে সংরক্ষণকাজ শেষ করার পর চরভদ্রাসন-ফরিদপুর সড়কের পূর্ব দিক ঘেঁষে মাটি দিয়ে উঁচু করে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ দেওয়া হয়। পরে ওই সড়ক দিয়ে এলাকাবাসীর বাড়িতে ঢুকতে সুবিধার জন্য বাড়ির সামনে থেকে বাঁধের মাটি কেটে সড়কের সমান করে নেয়। তিনি বলেন, এ কারণেই পদ্মা নদীর তীর উপচানো পানি সহজে লোকালয়ে ঢুকে পড়ায় ফরিদপুর পৌরসভাসহ আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
ফরিদপুর পৌরসভার মেয়র শেখ মাহাতাব আলী বলেন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের যেসব জায়গা জনগণ কেটে ফেলেছে, তা মেরামত করতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
বাড়িতে পানি, বিয়ের আয়োজন সড়কের পাশে
ভাজনডাঙ্গা হটিকালচাল সেন্টারের সামনে দেখা গেল সড়কের পাশে বড় বড় ডেকচি, সসপ্যান নিয়ে চলছে রান্নার আয়োজন। খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, ভাজনডাঙ্গা মহল্লার আবদুল হামিদের মেজ মেয়ে আরজু আক্তারের (১৮) বিয়ে উপলক্ষে এ আয়োজন।
বর সদরপুর উপজেলার কৃষ্ণপুর এলাকার জামাল জোয়াদ্দার (২৬)। তিনি পেশায় ইজিবাইকচালক। রাস্তার পাশে রান্না হচ্ছে বিয়েবাড়ির। বিয়ের খাবার রান্না হচ্ছে পোলাও, গরুর মাংস, মুরগির মাংস ও পায়েস।
আবদুল হামিদ বলেন, ‘করোনার কারণে অল্প কয়েকজন লোক নিয়ে এ আয়োজন। ২০ দিন আগে বিয়ে ঠিক হয়েছে। তখন কি কেউ জানত এক রাতেই পানিতে বাড়ি ডুইবা যাবে।’
‘এ এক আশ্চর্যজনক অবস্থা’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘গত রাইত তিনটার দিকে বাড়িঘর ডুইবা গেল। তারপরও বিয়ের এ আয়োজন করতে হয়েছে।’