গেল কদিনে ইফতারে মাকে পানি ছাড়া আর কিছুই খেতে দেখেনি ছোট আরিয়ান রহমান আলভির। ঘরে একমুঠো চালও নেই। স্কুল থেকে ফিরে তাই দুপুরে আর কিছু খাওয়া হয়নি। মা বলেছিলেন, ‘গোসল করে আয়। শহরে বড় ইফতার আছে। ওইখানে যাবনে।’ তবে কেন যেন মায়ের সে আশ্বাসে মন ভরেনি পাঁচ বছরের আরিয়ান রহমানের। তাই মাকে না জানিয়ে একাই শহরে চলে আসে সে।
‘মায়ের জন্য চাল কিনবে বলে’ গ্রাম থেকে আসার সময় এক বস্তা শাক কুড়িয়ে এনেছে আরিয়ান। এই শাক বিক্রি করে চাল কিনতে চায় সে। গত মঙ্গলবার রাত সাড়ে আটটার দিকে বাগেরহাট শহরের শালতলা এলাকার শহীদ মিনার সড়কে দেখা হয় তার সঙ্গে। পাশেই চলছিল বৈশাখী মেলা। সেখানে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে শিশুদের নাগরদোলায় চক্কর খেতে দেখেছে আরিয়ান।
কথায় কথায় আরিয়ান জানায়, শহরে রাস্তার পাশে শাক বিক্রি হয়, তা সে আগে দেখেছে। তাই গ্রামের একটি খালের পাশ থেকে শাক তুলে বিক্রির জন্য শহরে এসেছে। এক রাস্তার মোড়ে বসেও ছিল কিছুক্ষণ, তবে বিক্রি না হওয়ায় হেঁটে হেঁটে ঘুরতে থাকে রাস্তায়। এভাবে বিক্রিও হয়, তবে ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমেছে।
দুই আঁটি শাক আর বিক্রির ৮০ টাকা নিয়ে আরিয়ান হাঁটছিল শহরের শালতলা এলাকার রাস্তা দিয়ে। সেখানে একটা গেট ঘিরে বেশ জটলা দেখে উঁকি দেয় সে। ভেতর চলছিল মেলা। মানুষে ঠাসা সেখানকার খেলনা ও খাবার দোকান থেকে আরিয়ানও কেনাকাটা করেছে, তবে মায়ের জন্য। একটি দোকান থেকে সে কিনেছে একটি চামচ আর প্লাস্টিকের কৌটা। তাতেই শেষ তার শাক বিক্রির ৮০ টাকা।
ততক্ষণে সাড়ে আটটা বেজে গেছে। কিন্তু চালই কেনা হয়নি। তাই মেলার মাঠ থেকে বেরিয়ে শাক বিক্রির জন্য আবারও রাস্তায় যায় আরিয়ান। তখনই প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা হয় তার। তার বাবার বাড়ি রংপুরে। বাগেরহাটে সে থাকে মা আমেনা আক্তারের সঙ্গে। বাগেরহাট সদর উপজেলার ভাটশালা গ্রামে নানার জায়গায় থাকে তারা।
শাক বিক্রি করতে আসার ব্যাপারে ভাটশালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুশ্রেণির ছাত্র আরিয়ান বলে, ‘কী করব, ঘরে চাইল নেই। না খাইয়ে সকালে স্কুলে যাওয়া লাগে। তাই শাগ বেচতি আইছি কয়টা।’ তাহলে চাল না কিনে অন্য কিছু কেন কিনলে, জানতে চাইলে সে বলে, ‘এই দুই আঁটি ব্যাচা হলি তা–ই দিয়ে আম্মুর জন্যি চাইল কিনে নিয়ে যাব।’ দুই আঁটি শাক বিক্রির টাকায় চাল কেনা হবে? তার সরল উত্তর, ‘যে কয়টা হবে, সেই কয়টা কেনব। তা না হলি তো না খাইয়ে থাকতি হবেনে।’
আরিয়ানের গ্রাম থেকে শহর বাগেরহাট একদম কাছে না। মাঝে একটি নদীও আছে। খেয়ায় নদী পার হওয়া ছাড়া পুরোটা পথ সে হেঁটে এসেছে। সে বলে, ‘হাঁটতি আমার কষ্ট হয় না। কাছে টাহা তো নেই, ভ্যানে উঠলি আরও পায় ব্যাতা (ব্যাথা) হরে। চালির টাহা হলি তাই নিয়ে হাঁইটেই বাড়ি যাবানি।’
আরিয়ান জানায়, তার বাবা জেলে। দাদাবাড়ি থেকে তিন বছর আগে তাকে আর তার মাকে মেরে বের করে দেওয়া হয়। এর পর থেকে তারা নানাবাড়িতে থাকে। তবে নানাবাড়িতে তার সৎনানি। তিনি তাদের মা-ছেলেকে দেখতে পারেন না। তার মা অসুস্থ। অসুস্থতা নিয়েই মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে তার জন্য ভাত নিয়ে আসে।
দীর্ঘক্ষণ ধরে আলাপে তার কথায় কেবল চাল কেনার চিন্তাই ফুটে উঠছিল। ভাত কী দিয়ে খাবে, জানতে চাইলে আরিয়ান বলে, ‘আমার খাতি বেশি কিছু লাগে না। আমি শুধো ভাত নুন দিয়েও খাতি পারি। কোনো কষ্ট হয় না। কিন্তু চাইল না কিনলি তো কিছু হচ্ছে না। খাওয়া-দাওয়া হবে না নে।’