চালের রুটি ও গরুর মাংস ছাড়া রোহিঙ্গা শিবিরে ঈদ জমেনি

ঈদ উপলক্ষে কেনাকাটায় ব্যস্ত রোহিঙ্গা শিশুরা
ছবি: প্রথম আলো

ঈদের নামাজ শেষে রোহিঙ্গাদের ঘরে ঘরে চালের রুটির সঙ্গে গরুর মাংস খাওয়ার রীতি বহুদিনের। গত বছর বিভিন্ন সংস্থা রোহিঙ্গা শিবিরে বিনা মূল্যে কিছু মাংস সরবরাহ করেছিল। করোনা ঝুঁকির কারণে সেটা এবার হয়নি। শিবিরের বাইরে যাওয়াতেও নিষেধাজ্ঞা। তারপরও গোপনে উখিয়ার বাজার থেকে আনা কিছু মাংস বিক্রি হচ্ছিল শিবিরে। রোহিঙ্গা মাংসবিক্রেতা রহিম উল্লাহ (৪৫) বললেন, এর উদ্দেশ্য, ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করা। চালের রুটির সঙ্গে গরুর মাংস পরিবেশন না হলে রোহিঙ্গাদের ঈদ জমে না।

গতকাল শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২টা দিকে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং শিবিরের মুছরাবাজার এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, ১০-১৫ জন রোহিঙ্গা মাংস ভাগাভাগি করছেন। প্রতি কেজি মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ টাকায়। তাঁদের কেউ এক কেজি, কেউ আধা কেজি করে মাংস কিনে বাড়ি ফিরছেন। তবে শিবির ঘুরে দেখা গেল, এবার ক্যাম্পে মাংস কিনতে না পারা মানুষের সংখ্যাই বেশি।

দেড় মাস আগে (২২ মার্চ) ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে উখিয়ার বালুখালীসহ আশপাশের তিনটি আশ্রয়শিবিরের ১০ হাজার ১৬৫টি রোহিঙ্গা বসতি পুড়ে ছাই হয়। মারা যান ১১ জন। ধ্বংসস্তূপের ওপর তৈরি হয়েছে ত্রিপল ও বাঁশের তৈরি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঘিঞ্জি বসতি। টানাপোড়েনের সংসারে ঈদুল ফিতরের প্রথম ও দ্বিতীয় দিনটা কেটেছে অনেকের নিদারুণ দুঃখকষ্টে।

বালুখালী-৯ ক্যাম্পের সি-৩ ব্লকে ত্রিপলের ছাউনির নিচে বসতি করছেন রোহিঙ্গা জাফর আলম। ঘরে তাঁর স্ত্রী, তিন ছেলে ও শ্যালিকা। ঈদ কেমন কাটল, জানতে চাইলে জাফর আলমের জবাব, আগুনে তাঁর সবকিছু পুড়ে শেষ। সেদিন পরনের কাপড় নিয়ে সবাই পালিয়ে বেঁচেছিলেন। এরপর রোজার মাস কাটল খেয়ে না–খেয়ে। এই পরিস্থিতিতে ঈদ ভালো কাটান কী করে? জাফর আলম বলেন, ‘হাতে টাকা ছিল না বলে এই ঈদে সন্তানদের জন্য আধা কেজি মাংসও কিনতে পারলাম না।’

করোনার সংক্রমণ রোধে রোহিঙ্গা শিবিরে বাইরের লোকজনের প্রবেশে আছে নিষেধাজ্ঞা। আবার শিবিরের রোহিঙ্গারাও ইচ্ছা হলে বাইরে (উখিয়া-টেকনাফ) যেতে পারে না। প্রচণ্ড গরমে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর রাস্তাঘাট ফাঁকা পড়ে আছে।

ঈদের দিনে রোহিঙ্গা শিবিরে ঘুরে বেড়াচ্ছে শিশুরা

তবে রোহিঙ্গা শিশু-কিশোরেরা বসে নেই। ঈদের দিন সকাল থেকে তারা নতুন জামা গায়ে দিয়ে দল বেঁধে এ বাড়ি–ও বাড়ি ঘুরছে-খাচ্ছে। তবে চালের রুটি আর গরুর মাংস জুটছে না মোটেও। তার বদলে খেতে হচ্ছে সেমাই, হালুয়া ও রকমারি পিঠা।

লম্বাশিয়া শিবিরের রোহিঙ্গা কলিম উল্লাহ বললেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে থাকতে তাঁদের বলিবাজার গ্রামে শতাধিক গরু জবাই হতো। চালের রুটির সঙ্গে গরুর মাংস পরিবেশন চলত ঈদের পুরো তিন দিন। এর বাইরে পরিবেশন হতো সেমাই, হালুয়াসহ নানা পিঠাপুলি। কিন্তু এখানে (শিবিরে) সে সুযোগ নেই। এবারের ঈদে ৯০ শতাংশ রোহিঙ্গা পরিবারে চালের রুটির সঙ্গে গরুর মাংস খাওয়া হচ্ছে না।

বলিবাজার এলাকার রোহিঙ্গা সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘এখন বাঁশ ও ত্রিপল টাঙিয়ে কোনো রকমে মাথাগোঁজার ঠাঁই হলেও ভোগান্তির শেষ নেই। ঘরে দুই তরুণী মেয়েসহ পাঁচ ছেলেমেয়ে, ঈদের তাদের কিছুই কিনে দিতে পারিনি, চালের রুটি, গরুর মাংসও খাওয়া হয়নি। অন্য কোথাও গিয়ে যে চালের রুটি আর গরুর মাংস খাব, সে সুযোগও নেই।’

রোহিঙ্গা শিবিরে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক ও পুলিশ সুপার নাইমুল হক প্রথম আলোকে বলেন, রোহিঙ্গারা সুন্দরভাবেই ঈদের প্রথম দিনটা কাটিয়েছে। সকালে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে তারা মসজিদে মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় করেছে। সারা দিনে কোথাও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।