বাবার শ্রাদ্ধানুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফেরার পথে পিকআপের চাপায় পাঁচ ভাই নিহতের ঘটনায় জড়িত ওই পিকআপের চালক ধরা পড়ায় স্বস্তি প্রকাশ করেছে নিহতদের পরিবার। চালককে আটকের খবরে তাঁদের মা মানু রানী সুশীল বলেন, পিকআপচাপায় তাঁর পাঁচ ছেলের মৃত্যুর ঘটনা ছিল পরিকল্পিত। এটি দুর্ঘটনা নয়, হত্যাকাণ্ড। আটক পিকআপচালককে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে ঘটনার আসল রহস্য বেরিয়ে আসবে।
৮ ফেব্রুয়ারি ভোরে পিকআপচাপায় নিহত হন মানু রানীর ছেলে অনুপম সুশীল (৪৬), নিরুপম সুশীল (৪০), দীপক সুশীল (৩৫), চম্পক সুশীল (৩০) ও স্মরণ সুশীল (২৯)। আহত হন আরও তিন ভাইবোন। গত ৩০ জানুয়ারি মানু রানীর স্বামী সুরেশ চন্দ্র সুশীলের মৃত্যু হয়। ৮ ফেব্রুয়ারি ভোরে ৯ ভাইবোন স্থানীয় মন্দিরে তাঁদের বাবার শ্রাদ্ধানুষ্ঠান শেষ করে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন। এ সময় পিকআপ চাপা দিলে ঘটনাস্থলে চারজন ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আরেকজনসহ পাঁচ ভাইয়ের মৃত্যু হয়। ঘটনায় অক্ষত অবস্থায় বেঁচে যান মানু রানী সুশীলের মেয়ে মুন্নী সুশীল।
মুন্নী সুশীল বলেন, সকাল পাঁচটার দিকে মন্দিরের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে তাঁরা সাত ভাই দুই বোন বাড়িতে ফিরছিলেন। সবাই দাঁড়িয়ে ছিলেন মহাসড়কের এক পাশে। এমন সময় দ্রুতগতিতে ছুটে আসা পিকআপটি তাঁদের ওপর তুলে দেন। গুরুতর আহত ভাইবোনেরা যখন রাস্তায় যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন, তখন চালক গাড়িটি পেছনের দিকে নিয়ে এসে আহত ভাইদের আবার চাপা দেন যেন সবার মৃত্যু নিশ্চিত হয়। এরপর পিকআপ নিয়ে চালক কক্সবাজারের দিকে পালিয়ে যান। মুন্নী সুশীল বলেন, পিকআপ যখন প্রথম চাপা দেয়, তখন তিনি এক ভাইয়ের ধাক্কায় মাটিতে ছিটকে পড়েছিলেন। তাতে তিনি প্রাণে বেঁচে গেছেন। তিনি দাবি করেন, এটি দুর্ঘটনা নয়, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
একসঙ্গে পাঁচ সন্তান ও স্বামীকে হারিয়ে দিশাহারা মানু রানী সুশীল (৬১)। নিহত স্বামী ও সন্তানদের চিন্তায় নাওয়াখাওয়া ভুলে গেছেন তিনি। থেমে থেমে করেন কান্নাকাটি। প্রতিবেশীরা দেখতে গেলে তাকিয়ে থাকেন নির্বাক দৃষ্টিতে।
ঘটনার পর থেকে আত্মগোপনে ছিলেন পিকআপচালক সাহিদুল ইসলাম ওরফে সাইফুল (২২)। গতকাল শুক্রবার গভীর রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে সাইফুলকে আটক করে র্যাব। সাইফুলের বাড়ি পার্বত্য বান্দরবানের লামা উপজেলায়।
বাবার শ্রাদ্ধানুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফেরার পথে ৮ ফেব্রুয়ারি ভোরে পিকআপচাপায় নিহত হন মানু রানীর ছেলে অনুপম, নিরুপম, দীপক, চম্পক ও স্মরণ। আহত হন আরও তিন ভাইবোন।
র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে গাড়িচাপা দেওয়ার কথা স্বীকার করে আটক পিকআপচালক সাইফুল বলেন, তখন (৮ ফেব্রুয়ারি) সড়কে অতিরিক্ত কুয়াশা ছিল। দ্রুতগতিতে বিপজ্জনক বাঁক দিয়ে গাড়ি চালানোর কারণে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়নি। গাড়িতে ছিল পিকআপের মালিকের ছেলে তারেক ও তাঁর ভাগনে রবিউল। দুর্ঘটনার পর সাইফুল গাড়ি থামিয়ে আহত ব্যক্তিদের দেখতে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু মালিকের ছেলে তারেক তাঁকে গাড়ি নিয়ে দ্রুত চলে যেতে নির্দেশ দেন। ঘটনার পর থেকে পিকআপের মালিক চকরিয়ার পূর্ব বড়ভেওলার মাহমুদুল করিম ও রবিউল আত্মগোপনে রয়েছেন।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ কক্সবাজারের সভাপতি দীপংকর বড়ুয়া ও সাধারণ সম্পাদক প্রিয়তোষ শর্মা বলেন, পিকআপের চাপায় একসঙ্গে পাঁচ ভাইয়ের মৃত্যু বিশ্ববিবেককে নাড়া দিয়েছে। এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। আটক পিকআপচালককে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে, যেন দুর্ঘটনার নেপথ্য রহস্য উদ্ঘাটন হয়।
হাসিনাপাড়া গ্রামের মধ্যভাগে মানু রানী সুশীলের টিনের আধা পাকা বসতবাড়ি। আজ শনিবার দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা গেল, বাড়ির আঙিনায় চলছে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান। গতকাল শুক্রবার বাড়ির উঠানের একই জায়গায় মানু রানীর পাঁচ ছেলের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হয়। আজ হয় আমিষ খাবার স্পর্শের কাজ। মানু রানী, তাঁর নিহত পাঁচ ছেলের স্ত্রীরা, নাতি-নাতনি মিলে পরিবারের শতাধিক সদস্য পূজায় অংশ নেন। মানু রানীর স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে সবাইকে নিরামিষ খাবার খেতে হয়েছে এত দিন। পাঁচ ছেলের মৃত্যুর চতুর্থ দিনে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান সম্পন্ন করে পঞ্চম দিনে আজ পরিবারের ১৫০ জন সদস্যের মুখে মাছ-মাংস দিয়ে রান্না করা আমিষজাতীয় খাবার তুলে দেওয়া হয়।
উঠানের এক পাশে চেয়ারে বসে আনমনে কিছু যেন ভাবছিলেন মানু রানী সুশীল। পাশে ছিলেন দুর্ঘটনাস্থল থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া মেয়ে মুন্নী সুশীল। মানু রানী সুশীল বলেন, নিহত পাঁচ সন্তানের অশুভ রাশি কাটানোর ধর্মীয় অনুষ্ঠান কবে হবে, আজ বিকেলে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বৈঠকে বসে তা ঠিক করা হবে। এ অনুষ্ঠান দুর্ঘটনার ১৫ দিন পর হওয়ার কথা। অশুভ রাশি কাটানোর এ অনুষ্ঠান করলে নিহত ব্যক্তিরা স্বর্গে ভালো থাকবেন জানিয়ে মানু রানী বলেন, ‘ভগবানের কৃপা পেলে নিহত স্বামী-সন্তানেরা ভালো থাকবেন। স্বামী-সন্তানেরা যেন শান্তিতে থাকতে পারে, তার জন্য ঘটা করে শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের আয়োজন করতে চাই। কিন্তু সুযোগ নেই। একসঙ্গে স্বামীসহ পাঁচ সন্তানের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুতে সুখের সংসার তছনছ হয়ে গেল।’
মানু রানীর ছেলে রক্তিম সুশীল (৩৫) পড়ে আছেন চট্টগ্রাম মহানগরের একটি বেসরকারি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ)। আজ শনিবার বেলা তিনটা পর্যন্ত তাঁর শারীরিক উন্নতি দেখা যাচ্ছে না জানিয়ে রক্তিমের বোন মুন্নী সুশীলের স্বামী খগেশপ্রতি চন্দ্র খোকন বলেন, তাঁরা পরিবারের সবাই রক্তিমের জন্য প্রার্থনা করছেন।
মানু রানীর অপর ছেলে প্লাবন সুশীল (২৩) চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে শুক্রবার রাতে বাড়ি ফিরেছেন। তাঁকে ডুলাহাজারা খ্রিষ্টান মেমোরিয়াল হাসপাতালে রাখা হয়েছে। আহত মেয়ে হীরা সুশীলের (৪৫) চিকিৎসা চলছে একই হাসপাতালে। গত বৃহস্পতিবার তাঁর পায়ে অস্ত্রোপচার হয়েছিল।
নিহত অনুপম সুশীলের স্ত্রী পপি সুশীল (৩৫) বলেন, তাঁরা নিহত ভাইয়ের পাঁচ স্ত্রী অন্তত এক মাস শাশুড়ির সঙ্গে এ বাড়িতে থাকবেন। তাঁর স্বামী অনুপম সুশীল পল্লিচিকিৎসক ছিলেন। চট্টগ্রামের আজিজনগর বাজারে তিনি রোগী দেখে সংসার চালাতেন। তাঁর চলে যাওয়ার পর দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। সংসার চালানোর মতো কোনো সম্বল তাঁর নেই।
নিহত দীপক সুশীলের স্ত্রী পূজা সুশীল (২৬) বলেন, তিনি শ্বশুরবাড়িতে এক মাস থাকবেন। তাঁর একমাত্র ছেলে আয়ূশ সুশীলকে (৬) নিয়ে যত দুশ্চিন্তা তাঁর।
পূজা সুশীলের স্বামী দীপক সুশীল কাতারপ্রবাসী ছিলেন। সেখানে দীপকের একাধিক দোকান ছিল। বাবার শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে এসে পিকআপচাপায় মারা গেলেন তিনি। এখন কাতারের দোকানের খবর নেওয়ার লোক নেই জানিয়ে পূজা সুশীল বলেন, তাঁর হাতে স্বামীও কিছু রেখে যেতে পারেননি।
মুন্নী সুশীলের স্বামী খগেশপ্রতি চন্দ্র খোকন বলেন, আজ দুপুরে আমিষ খাবার মুখে দেওয়ার মধ্য দিয়ে নিহত পাঁচ ভাইয়ের ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী অনুষ্ঠানাদি শেষ হয়েছে। বিকেল থেকে দূরদূরান্ত থেকে আসা স্বজনেরা ফিরতে শুরু করেছেন। তিনি সন্ধ্যায় স্ত্রীকে (মুন্নী সুশীল) নিয়ে লামায় ফিরে যাবেন। এখন বিচারের জন্য অপেক্ষা। আক্ষেপের সুরে খগেশপ্রতির জিজ্ঞাসা, সব সড়ক দুর্ঘটনার মতো এই পিকআপচালকেরও হয়তো কিছুদিনের শাস্তি হবে। কিন্তু যাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদের কী হবে? একটি দুর্ঘটনা পাঁচটি পরিবারের ১৪ জন মানুষের সারা জীবনের কান্না, এ কান্নার দায় কি রাষ্ট্র নেবে?