কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উনচিপ্রাং বাজার থেকে পশ্চিম দিকে দুই কিলোমিটার গেলে পাহাড়ঘেরা পুঁটিবনিয়া চাকমাপল্লি। বংশপরম্পরায় এ পল্লিতে বসবাস করছেন ২৮ চাকমা পরিবারের প্রায় ১৪০ জন। একসময় চাকমা পল্লির মানুষ আশপাশের পাহাড় ও সমতলের জমিতে চাষাবাদ করে সংসার চালাতেন।
২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ঢল শুরু হলে চাকমাপল্লির বাসিন্দারা বিপাকে পড়েন। ওই পল্লিসহ আশপাশের পাহাড়-জঙ্গল কেটে গড়ে তোলা হয় প্রায় ২২ হাজার রোহিঙ্গার উনচিপ্রাং আশ্রয়শিবির। এতে সাড়ে চার বছর ধরে চাকমা পরিবারগুলো আশ্রয়শিবিরের ভেতরেই বন্দিজীবন কাটাচ্ছে।
পাহাড়ঘেরা আশ্রয়শিবিরটির চারদিক কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। ফলে চাকমাদের মিলেমিশে থাকতে হচ্ছে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে। খাদ্য, পানি, পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা, নিরাপত্তাসহ নানা সংকটে দিশেহারা পল্লির বাসিন্দারা। এ ছাড়া মিয়ানমারের উগ্র মগ সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে চাকমাদের চেহারায় মিল থাকায় রোহিঙ্গারা তাদের সহ্য করতে পারে না।
গত ৩১ মার্চ সকালে চাকমাপল্লিতে গিয়ে দেখা যায়, একটি বাড়ির আঙিনায় বিমর্ষ হয়ে বসে আছেন উকিলা চাকমা (৫৭)। কাছে যেতেই তিনি বলেন, ‘পল্লির চারপাশে রোহিঙ্গা বসতি। রোহিঙ্গারা তাঁদের দেখে ভিন্ন দৃষ্টিতে। অন্য কোথাও মাথা গোঁজার ঠাঁই নাই, এখান থেকে ঘরবাড়ি তুলে নিয়ে চলে যাব। এখানে কোনো নিরাপত্তা নাই।’
পল্লির এক পাশে মং চিচা চাকমার (৮১) আধা পাকা বাড়ি। তাঁর জীবন কেটেছে এ পাহাড়ে। বর্তমানে সময় প্রতিকূলে জানিয়ে মং চিচা চাকমা বলেন, পাঁচ বছর আগেও চাকমারা সচ্ছল জীবন কাটিয়েছেন। পাহাড়ে জীবনধারণের নানা উপায় ছিল। এখন কিছু নেই। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বলেন, ‘আমরা অসহায়, আমাদের পাশে কেউ নাই।’
মংচিচা চাকমার প্রতিবেশী সমাজপতি নিচামং চাকমা (৬২) বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কারণে চাকমাদের জীবন–জীবিকা হুমকিতে পড়েছে। রোহিঙ্গারা জাতিসংঘসহ নানা সংস্থার মানবিক সহায়তা পেলেও স্থানীয় জনগোষ্ঠী হিসেবে চাকমারা কিছুই পাচ্ছে না।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে এসে কক্সবাজরের টেকনাফ ও উখিয়ায় আশ্রয় নেয় ৮ লাখ রোহিঙ্গা। এর আগে বিভিন্ন সময় এসেছে আরও কয়েক লাখ। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১১ লাখ। এর মধ্যে উনচিপ্রাং (ক্যাম্প-২২) আশ্রয়শিবিরে আছে ২২ হাজার রোহিঙ্গা।
চাকমাপল্লির কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পল্লির চারপাশে চাষাবাদের ৭৮ হেক্টর জমি ছিল। এর সবটুকুই চলে গেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পেটে। ক্যাম্প গড়তে গিয়ে চাকমাদের ফসলি জমি, পাহাড়ের গাছপালা, প্রাকৃতিক ঝরনা ও ছড়া ধ্বংস করা হয়। পাঁচ বছর আগেও পল্লির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া রইক্ষ্যং খালে (পাহাড়ি ছড়া) ব্লক (অস্থায়ী বাঁধ) বসিয়ে বছরজুড়ে চাষাবাদ করতেন তাঁরা। উৎপাদিত ফসল বিক্রি হতো উনচিপ্রাং ও হোয়াইক্যং বাজারে। এখন রোহিঙ্গা বর্জ্যে খালটি ভরাট হয়ে গেছে। পানি চলাচল বন্ধ থাকায় দূষণের শিকার হয়ে খালটি এখন অস্তিত্বসংকটে পড়েছে। পাহাড় কেটে আশ্রয়শিবির গড়ে ওঠায় চাকমাদের জুমচাষও বন্ধ। আয়ের সব দিক বন্ধ হওয়ায় সংসার পরিচালনা এবং উপার্জন নিয়ে দিশাহারা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর এই মানুষগুলো।
চাকমাপল্লির কয়েকজন বাসিন্দা জানান, পল্লির শিশুদের পড়াশোনার জন্য বেসরকারি একটি উন্নয়ন সংস্থার স্কুল ছিল। রোহিঙ্গা ক্যাম্প হওয়ার পর সেটিও বন্ধ হয়ে গেছে। ক্যাম্পের ভেতরের রাস্তা দিয়ে শিশুদের কয়েক কিলোমিটার দূরে উনচিপ্রাং বাজারের কাছে স্কুলে যাতায়াত করতে হয়। অপহরণের ভয়ে চাকমা শিশুদের ঘর থেকে একাকী কোথাও বের হতে দেওয়া হয় না। এতে এখন তাদের পড়াশোনাও বন্ধ।
চাকমা সম্প্রদায়ের কয়েকজন বলেন, বছরখানেক আগে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ড হয়। তখন রোহিঙ্গা বসতির পাশাপাশি পুড়ে যায় পল্লির মাছু চাকমার বাড়িটিও। রোহিঙ্গাদের বাড়িগুলো বিভিন্ন এনজিও সংস্থা পুনর্নির্মাণ করে দিলেও মাছু চাকমার পরিবার এখন পলিথিনের ঝুপড়িতে অমানবিক জীবন কাটাচ্ছে। মাছু চাকমা বলেন, আঙিনায় গাছপালা রোপণ বা চাষাবাদ করলে সেগুলোও লুট করে নিয়ে যায় রোহিঙ্গারা। বাড়িতে প্রাপ্তবয়স্ক নারী থাকায় কোথাও গেলে সন্ধ্যার আগেই ফিরতে হয়। রোহিঙ্গাদের ভয়ে চাকমা মেয়েরা পাহাড়ে চাষাবাদ তো দূরের কথা, বাড়ি থেকেও বের হতে পারে না।
একসময় চাকমাপল্লিতে ৩৫ পরিবারের বাস ছিল। নানা সংকটের মুখোমুখি হয়ে অনেকে চলে গেছেন। সর্বশেষ জানুয়ারি মাসে দুই পরিবার ভিটেমাটি ছেড়ে হোয়াইক্যং ইউনিয়নের হরিখোলা চাকমাপল্লিতে চলে যায়। এখন আছে ২৮ পরিবার। পল্লির বাসিন্দাদের ভাষ্য, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন দীর্ঘস্থায়ী হলে তাঁদের জীবন-জীবিকা আরও ঝুঁকিতে পড়বে। রোজগারের বিকল্প ব্যবস্থা না হলে সবাইকে না খেয়ে মরতে হবে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন তাঁরা।
স্থানীয় হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারী বলেন, চাকমা পরিবারগুলোকে ইউপির পক্ষ থেকে যৎসামান্য সহযোগিতা দেওয়া হয়। কিন্তু রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পক্ষ থেকে তাঁদের কোনো ধরনের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে না।
নুর আহমদ আনোয়ারী আরও বলেন, রইক্ষ্যং খালটির একটি মুখ পাহাড়ের দিকে (চাকমাপল্লি) গেছে, আরেকটি গেছে ক্যাম্পের দিকে। ক্যাম্পের ভেতরের খালে বাঁধ নির্মাণ করে সেই পানি শোধন করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সরবরাহ করছে অক্সফাম নামের একটি বেসরকারি সংস্থা। খালের অপর অংশটি রোহিঙ্গাদের ফেলা পলিথিনের বর্জে ভরে গেছে। ফলে দক্ষিণ পাড়ায় খালে এলজিইডি কর্তৃক ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত স্লুইসগেটটি অচল হয়ে পড়েছে। এ কারণে চাকমা পল্লিসহ ক্যাম্পের আশপাশের অন্তত ৫০০ একর জমির চাষাবাদ বন্ধ হয়ে গেছে। এতে বিপাকে পড়েছে চাকমাসহ ২৫১ পরিবারের অন্তত দেড় হাজার কৃষক।
চাকমাপল্লির নিরাপত্তা এবং সহযোগিতা প্রসঙ্গে কক্সবাজারের অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা বলেন, প্রথম দিকে চাকমা পরিবারগুলোকে কয়েক দফা ত্রাণসহায়তা ও কয়েকজনকে চাকরিও দেওয়া হয়েছিল। এখন তারা কী অবস্থায় আছে, তা সরেজমিনে দেখে তিনি ব্যবস্থা নেবেন।