সুনামগঞ্জ পৌর শহরের সরকারি জুবিলী উচ্চবিদ্যালয়ের সীমানাপ্রাচীরের মধ্যে পাকা প্রাঙ্গণে ভেজা ধান মেলে দিয়েছেন কৃষক নূর মিয়া (৬৫)। বাড়ি থেকে প্রায় ৭০ মণ ধান নিয়ে এসেছেন তিনি। ঘরের মধ্যে স্তূপ করে রাখা এসব ধানে অঙ্কুর গজিয়েছে। একটু পরপর সেই ধান নেড়ে দিচ্ছিলেন। তাঁর মধ্যে একটু হলেও স্বস্তির ভাব লক্ষ করা যায়। ১৫ দিন পর রোদের দেখা পেয়েছেন। এ সুযোগে ধান শুকাতে পারলেই রক্ষা।
কৃষক নূর মিয়ার বাড়ি সদর উপজেলার গৌরারং ইউনিয়নের রাধানগর গ্রামে। জেলা শহর থেকে ওই গ্রামের দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার। রোদ ওঠায় প্রথমে গ্রাম থেকে নৌকায়, পরে পিকআপে করে এই ভেজা ধান শহরে নিয়ে এসেছেন। এলাকায় এখন চারদিকে বন্যার থই থই পানি। ধান শুকানোর জায়গার বড় অভাব। তাই ধান নিয়ে শহরে এসেছেন তিনি।
সুরমা নদীর পানি আজ বিপৎসীমার নিচে আছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১৮ সেন্টিমিটার পানি কমেছে। সুনামগঞ্জে বৃষ্টি হতে পারে। তবে সেটা ভারী নয়, হালকা।সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহুরুল ইসলাম
নূর মিয়া জানালেন, এবার এলাকার করচার হাওরে তিন একর জমিতে বোরো আবাদ করেছিলেন তিনি। ঈদের পরে ধান কেটে মাড়াই করেছেন। তারপরই শুরু হয় বৃষ্টি। এত দিন ঘরেই ছিল এসব ধান। ঘরে স্তূপ করে রাখা ধান যাতে নষ্ট না হয়, সে জন্য কিছুক্ষণ পরপর বৈদ্যুতিক পাখা দিয়ে ধানে বাতাসের ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। অনেক ধানে অঙ্কুর গজিয়েছে। স্কুলের একজন পরিচিত শিক্ষককে এই দুর্ভোগের কথা জানালে তিনিই ধান শহরে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
শুধু নূর মিয়া নন, টানা বৃষ্টিতে হাওরের ধান মাড়াই ও শুকানো নিয়ে অনেক কৃষকই বিপাকে পড়েছেন। আজ রোববার রোদ ওঠায় তাঁদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। সদর উপজেলার নিধিচর গ্রামের বাসিন্দা শাহ নূর জানান, তাঁদের এলাকার সুনামগঞ্জ-জামালগঞ্জ সড়কের ওপর সকাল থেকে শত শত কৃষক ধান মাড়াই ও শুকানোর কাজ করছেন। এর মধ্যে গ্রামের অনেকের ধান শুকাতে না পেরে নষ্ট হয়েছে। একদিকে বন্যার পানিতে তলিয়েছে ধান, অন্যদিকে শুকাতে না পেরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কৃষকেরা।
সদর উপজেলার জগাইরগাঁও গ্রামের কৃষক আব্বাস আলী জানান, তাঁর বাড়িতেও ৩০ মণ ধান ছিল। আজ সকাল থেকে গ্রামের পাশে সুনামগঞ্জ-জামালগঞ্জ সড়কে সেই ধান এনে মেলে দিয়েছেন। আব্বাস আলী প্রথম আলোকে বলেন, সবখানে বন্যার পানি। সড়ক ছাড়া কোনো জায়গা নেই। সবাই ধান নিয়ে সড়কে আসছেন। দু-এক দিন রোদ পেলেই ধানগুলো রক্ষা পাবে।
এপ্রিলের প্রথম দিকে এবার উজানে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জের বেশ কিছু হাওরের ফসলহানির ঘটনা ঘটে। এখন টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢলে সৃষ্ট বন্যায় বিপাকে পড়েছেন হাওরের কৃষকেরা। এক সপ্তাহ ধরে সুনামগঞ্জের পাঁচটি উপজেলা বন্যাকবলিত। বন্যার পানিতে হাওরের উঁচু অংশে থাকা অনেক কৃষকের ফসল তলিয়ে গেছে।
বন্যায় সুনামগঞ্জে ৮২৯ হেক্টর জমির বোরো ধান তলিয়েছে। এবার ছোট–বড় ১৩৭টি হাওরে ২ লাখ ২২ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছিল। এপ্রিলের ঢলে ২০টি হাওরের প্রায় ৬ হাজার হেক্টর জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হাওরের ভেতরের ধান কাটা শেষ হলেও উঁচু অংশের প্রায় ৬ হাজার হেক্টর জমির ধান এখনো কাটা বাকি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ বন্যায় সুনামগঞ্জে ৮২৯ হেক্টর জমির বোরো ধান তলিয়েছে। জেলায় এবার ছোট–বড় ১৩৭টি হাওরে ২ লাখ ২২ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছিল। এপ্রিলের পাহাড়ি ঢলে ২০টি ছোট–বড় হাওরের প্রায় ৬ হাজার হেক্টর জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হাওরের ভেতরের ধান কাটা শেষ। তবে হাওরের উঁচু অংশের প্রায় ৬ হাজার হেক্টর জমির ধান কাটা এখনো বাকি। এগুলো কাটতে আরও ১০ দিন সময় লাগবে। এ ছাড়া বন্যায় বাদাম ৭০ হেক্টর, আউশ ধানের বীজতলা ৪৮ হেক্টর ও ৪০ হেক্টর জমির সবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম প্রথম আলোকে বলেন, টানা বৃষ্টির কারণে কৃষকেরা ধান মাড়াই ও শুকানো নিয়ে বিপাকে ছিলেন। এখন রোদ ওঠায় সবার মধ্যে একটা স্বস্তি ফিরে এসেছে। পানি দ্রুত নেমে গেলে নিমজ্জিত ধান নষ্ট হবে না বলে তিনি জানান।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, সুরমা নদীর পানি আজ বিপৎসীমার নিচে আছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১৮ সেন্টিমিটার পানি কমেছে। সুনামগঞ্জে বৃষ্টি হতে পারে। তবে সেটা ভারী নয়, হালকা।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে। নদী ও হাওরে পানি কমতে শুরু করেছে। আশা করি, দু-এক দিনের মধ্যে পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে। বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত আছে।’