বিভিন্ন যানবাহন থেকে বছরে চাঁদা ওঠে প্রায় ৭৫ কোটি টাকা। এর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে খুনোখুনিও কম নয়।
উত্তরবঙ্গের ১১ জেলার যানবাহন চলাচল করে বগুড়ার ওপর দিয়ে। আর এসব পরিবহনে চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ যাঁদের হাতে, তাঁরা এখানকার রাজনীতিরও নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছেন।
সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং হাইওয়ে পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, বগুড়ার ওপর দিয়ে দিনে গড়ে ১০ হাজারের মতো যানবাহন চলাচল করে। এর মধ্যে বাস আড়াই হাজার এবং ট্রাক সাড়ে তিন হাজারের মতো।
মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি বড় যানবাহন থেকে গড়ে ২৫০ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হতো। বছর শেষে চাঁদার অঙ্কটা দাঁড়ায় প্রায় ৫৫ কোটি টাকা। আর তিন চাকার ছোট যানবাহনগুলো থেকে চাঁদা আসে বছরে প্রায় ২০ কোটি টাকা। এই জেলায় বিভিন্ন প্রকার তিন চাকার যান আছে প্রায় ১০ হাজার। এসব ছোট যানকে কয়েক ঘাটে চাঁদা দিতে হয়।
এখন বগুড়ায় রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে চাঁদাবাজি। কোনোরকমে একটা পদ বাগিয়েই চাঁদাবাজিতে যুক্ত হওয়া যায়।মাসুদার রহমান, সভাপতি, সচেতন নাগরিক কমিটি, বগুড়া
বগুড়ার স্থানীয়রা বলছেন, বাস, ট্রাক ও অটোরিকশা থেকে তোলা চাঁদাকে ঘিরেই বগুড়ার স্থানীয় রাজনীতি আবর্তিত হয়। চাঁদাবাজির কর্তৃত্ব যাঁর হাতে, পদবি যা–ই হোক না কেন, তিনিই হয়ে ওঠেন রাজনীতির নিয়ন্ত্রক। ঘুরেফিরে এক দশক ধরে ছয়জনের হাতেই চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ। তাঁরাই জেলার রাজনীতির মূল নিয়ন্ত্রক। চাঁদাবাজি নিয়ে জেলায় খুনোখুনিও কম হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১২ বছরে বগুড়ায় ৩০ জন রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী খুন হন।
এই চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিতে আবারও অশান্ত হয়ে উঠেছে বগুড়ার রাজনীতি। গত মঙ্গলবার এ নিয়ে সংঘর্ষে জড়ায় বগুড়া মোটর মালিক গ্রুপের দুটি পক্ষ। এর একটি পক্ষের নিয়ন্ত্রণ করছেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুরুল আলম ওরফে মোহন। তিনি মোটর মালিক গ্রুপের সাবেক আহ্বায়ক। আরেক পক্ষে নেতৃত্ব দিচ্ছেন জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক শাহ আকতারুজ্জামান। তিনি মোটর মালিক গ্রুপের সর্বশেষ কমিটির সভাপতি। তাঁর পক্ষে আছেন সদর উপজেলা যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আমিনুল ইসলাম। তিনি মোটর মালিক গ্রুপের সর্বশেষ কমিটির সাধারণ সম্পাদক।
গত বিএনপির আমলেও বগুড়ায় পরিবহন চাঁদাবাজদের পোয়াবারো ছিল। তখন বিএনপি নেতারা এই চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক শাহ আক্তারুজ্জামান (ডিউক) ও জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান যুগ্ম সম্পাদক সাগর কুমার রায় মোটর মালিক গ্রুপের সভাপতি-সম্পাদক বনে যান।
আমিনুল ও আক্তারদের সঙ্গে আছে মান্নান-হেলাল-মতিন গ্রুপ। এর মধ্যে আবদুল মান্নান ট্রাক, ট্যাংক লরি ও কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সভাপতি আর আবদুল মতিন (আলোচিত তুফান সরকারের ভাই) সম্পাদক। আর শামসুদ্দীন শেখ হেলাল জেলা শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক, মালিক-শ্রমিক যৌথ কমিটির সভাপতি।
স্থানীয়রা জানান, শহরের মোটর মালিক গ্রুপ, ট্রাক, ট্যাংক লরি ও কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতি এবং পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন ও ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের নামে বগুড়ায় চাঁদা তোলা হয়। এই সংগঠনগুলোর নিয়ন্ত্রণ যাঁর হাতে, তাঁর হাতেই রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ।
গত বিএনপির আমলেও বগুড়ায় পরিবহন চাঁদাবাজদের পোয়াবারো ছিল। তখন বিএনপি নেতারা এই চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক শাহ আক্তারুজ্জামান (ডিউক) ও জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান যুগ্ম সম্পাদক সাগর কুমার রায় মোটর মালিক গ্রুপের সভাপতি-সম্পাদক বনে যান। তাঁরা ছয় বছর সেই পদ দখল করে ছিলেন।
এরপর নির্বাচনের দাবি উঠলে মঞ্জুরুল আলম ওই গ্রুপের আহ্বায়ক হয়ে আরও তিন বছর পার করে দেন। ২০১৮ সালে শাহ আক্তারুজ্জামান সভাপতি ও আমিনুল ইসলাম সম্পাদক হন। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার মোটর মালিক গ্রুপের কার্যালয়ের দখল নিতে কয়েক শ লোক নিয়ে যান মঞ্জুরুল আলম। দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। ওই সংঘর্ষের ঘটনায় তিনটি মামলা হয়। তার মধ্যে দুটি মামলায় মঞ্জুরুল আর একটি মামলায় আমিনুলকে আসামি করা হয়েছে। মামলার আসামি হওয়ার পর দুজনকেই আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। তাঁরা দুজনেই উচ্চ আদালত থেকে জামিনের চেষ্টা করছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।
সংঘর্ষের পরপর গত মঙ্গলবার মঞ্জুরুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, আমিনুলরা মালিক গ্রুপের প্রভাব ব্যবহার করে বগুড়ার ওপর দিয়ে যাওয়া প্রতিটি বাস থেকে ৩০০ টাকা করে নিচ্ছেন।
আর চাঁদাবাজির অভিযোগ সম্পর্কে আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা (চাঁদা) তো সারা বাংলাদেশে বন্ধ হয়ে গেছে। এখন শ্রমিক ইউনিয়ন ৩০, আমাদের (মালিক গ্রুপের) ৩০, টোল ৫০, চেইন মাস্টার ১০ টাকা কর নেয়। আর ঠনঠনিয়া থেকে যে কোচগুলো ছাড়ে ওর টোল ৫০ টাকা। এটা আমাদের কেন্দ্রের থেকে অনুমোদন করা আছে।’
জেলায় টার্মিনালের বাইরে চাঁদাবাজি হয় না বলে দাবি পুলিশ সুপারের। বগুড়ার পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূঞা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, দুই বছর ধরে টার্মিনালের বাইরে কোনো চাঁদাবাজি হয় না। একাধিকবার টার্মিনালের বাইরে চাঁদা তোলার চেষ্টা হয়েছে, পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের গ্রেপ্তার করেছে, মামলাও হয়েছে। মোহন (মঞ্জুরুল আলম) যে বাসে ৩০০ টাকা করে চাঁদা নেওয়ার কথা বলেছেন, সেটি সত্য নয়। মঞ্জুরুল ও আমিনুলকে গ্রেপ্তারে পুলিশের ভূমিকা প্রসঙ্গে পুলিশ সুপার বলেন, ‘রাজনৈতিক বিবেচনায় কোনো অনুকম্পা দেখানোর সুযোগ নেই। প্রধান দুই আসামি মোহন আর আমিনুল বগুড়ায় নেই। তাঁদের ধরতে পুলিশের একাধিক দল মাঠে কাজ করছে।’
গত ২০১৭ সালে বগুড়ায় এক কিশোরীকে ধর্ষণ এবং ওই মেয়ে ও তাঁর মাকে ন্যাড়া করে দেওয়ার ঘটনায় শহর শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক তুফান সরকার ও তাঁর ভাই শহর যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক মতিন সরকার আলোচনায় আসেন। দুই ভাইকেই সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়। এসব সমালোচনার মধ্যেই ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে বগুড়ায় এসে একাধিক হত্যা ও মাদকের মামলার আসামি মতিন সরকারের বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেন সাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রী ও পরিবহন নেতা শাজাহান খান।
এরপর মতিনের অবস্থান পাল্টে যায়। মতিন এখন আওয়ামী লীগের কোনো পদে না থাকলেও জেলা ট্রাক মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের পদটি ধরে রেখেছেন। ওই সংগঠনের নামে ট্রাকগুলো থেকে ৩০ টাকা নিয়ে যে রসিদ দেওয়া হচ্ছে তাতে মতিনের স্বাক্ষরযুক্ত সিল রয়েছে। ২৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় বগুড়া পৌরসভা নির্বাচনে মতিন কাউন্সিলর প্রার্থী হয়েছেন। স্থানীয়রা বলছেন, যত দিন হাতে চাঁদা আছে, তত দিন তাঁর রাজনীতিও আছে।
একসময় বগুড়ায় আওয়ামী লীগ বলতে লোকে মমতাজউদ্দীনকেই বুঝত। ১৯৮৫ সাল থেকে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে ছিলেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসার পর দলীয় রাজনীতিতে তিনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন। তখনকার জেলা যুবলীগের সভাপতি মঞ্জুরুল আলম (মোহন) কিছু লোক নিয়ে পরিবহনের চাঁদা নিয়ন্ত্রণ শুরু করেন। ২০১৪ সালে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক হন মঞ্জুরুল। তখন মঞ্জুরুলের সঙ্গে একজোট হয়ে চাঁদা নিয়ন্ত্রণ করতেন আবদুল মান্নান, শামসুদ্দীন শেখ হেলাল, আমিনুলরা। পরে আধিপত্যের বিরোধে মঞ্জুরুলের থেকে তাঁরা আলাদা হয়ে যান।
এই মঞ্জুরুল, আমিনুল, শামসুদ্দীনরাই বগুড়ার রাজনীতির প্রধান কুশীলব হয়ে উঠেছেন। নেতাদের তাঁরাই চালান। জেলা আওয়ামী লীগের একটা বড় অংশ মঞ্জুরুলের পক্ষে রয়েছেন। আরেকটা অংশ এখন মান্নান-আক্তারুজ্জামান-আমিনুলদের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছেন।
২৮ ফেব্রুয়ারি বগুড়া পৌরসভার নির্বাচন। এখানেও পরিবহন খাত নিয়ন্ত্রণকারীদের দাপট। এবারের বগুড়ার পৌরসভার নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন পরিবহন নেতা আবদুল মান্নান। আর বিএনপির মেয়র প্রার্থী হয়েছেন রেজাউল করিম বাদশা, তিনি আওয়ামী লীগ নেতা মঞ্জুরুল আলমের ভাই। বাদশা ও মান্নানকেই পৌরসভার প্রধান প্রার্থী মনে করা হচ্ছে। এই দুজনের তুলনায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী কিছুটা কোণঠাসা বলে জানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন।
জেলা ট্রাক মালিক সমিতির সভাপতি ও পরিবহন মালিক-শ্রমিক যৌথ কমিটির মুখপাত্র এবং মেয়র প্রার্থী আবদুল মান্নান আকন্দ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব সংগঠনে যাঁরা আছেন, তাঁরাও চাঁদাবাজ, যাঁরা দখল করতে আসেন তাঁরাও চাঁদাবাজ।’
গত এক যুগে বগুড়ায় যে রাজনৈতিক খুনগুলো হয়েছে তার বেশির ভাগেরই নেপথ্যে ছিল চাঁদাবাজি, দখল ও আধিপত্য বিস্তার। ২০১৯ সালের ১৪ এপ্রিল খুন হন একসময় পরিবহন নিয়ন্ত্রণকারী বিএনপির নেতা মাহবুব আলম ওরফে শাহীন। তাঁর স্ত্রী আকতার জাহান বগুড়া পৌর কাউন্সিলর আমিনুল ইসলামকে প্রধান আসামি করে মামলা করেন। আমিনুল গ্রেপ্তার হয়ে কিছুদিন জেলে ছিলেন। জামিনে বেরিয়ে আবার মোটর মালিক গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন।
২০১২ সালের ২৯ নভেম্বর রাতে শহরের খান্দার এলাকায় নিজ বাড়ির কাছেই খুন হন বগুড়া শহর আওয়ামী লীগের নেতা সুজানুর রহমান। এই হত্যা মামলার প্রধান আসামি মোস্তাকিম রহমান বর্তমানে যুবলীগের ওয়ার্ড কমিটির শীর্ষ নেতা। তিনি মঞ্জুরুল আলমের ক্যাডার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। পরে তিনি কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ওই ওয়ার্ডে এবার মনোনয়ন পেয়েছেন জেলা যুবলীগের সহসভাপতি আলহাজ শেখ। তিনি বগুড়া জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু হানিফ ওরফে মিস্টারসহ একাধিক হত্যা মামলার আসামি। আলহাজ শেখ এখন সিএনজি অটোরিকশায় চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন। সিএনজি অটোরিকশা মালিকদের একটি সমিতির নেতাও তিনি। আলহাজ শেখ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি স্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রণ করেন। তবে করোনা শুরু হওয়ার পর মালিক সমিতির নামে চাঁদা তোলা হচ্ছে না।
গত বছর করোনার মধ্যেও বগুড়ার খুনখারাবি বন্ধ ছিল না। গত বছরের ৫ জুন বগুড়া শহরের শাকপালা মোড়ে দিনদুপুরে কুপিয়ে হত্যা করা হয় বগুড়া জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু হানিফ ওরফে মিস্টারকে (৪০)। তিনি ২০১৩ সালে শাজাহানপুরের যুবলীগ নেতা মজনু এবং তাঁর ভাতিজা নাহিদ (জোড়া খুন) হত্যাসহ ৯টি মামলার আসামি ছিলেন। তদন্তকারীরা জানান, এই হত্যার নেপথ্যে ছিল সিএনজি অটোরিকশার চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধ।
বগুড়ার একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক জানালেন, ‘আগে রাজনীতিবিদেরা এদের (চাঁদাবাজদের) চালাত, এখন এই চাঁদাবাজেরা রাজনীতি চালায়।’
সচেতন নাগরিক কমিটি বগুড়ার সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুদার রহমান বলেন, এখন বগুড়ায় রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে চাঁদাবাজি। কোনোরকমে একটা পদ বাগিয়েই চাঁদাবাজিতে যুক্ত হওয়া যায়। প্রশাসনের সঙ্গে আঁতাত করে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা সব নিয়ন্ত্রণ করছেন।