জমির ধানের শিষগুলো নেড়েচেড়ে দেখছিলেন রিয়াজ উদ্দিন। এ সময় তিনি বললেন, ধান কাটার মতো হয়েছে কি না, তা দেখছেন। ঝড়বৃষ্টির খবর শুনে তাঁর খুব চিন্তা হচ্ছে। শিল পড়লে পাকা ধান ঝরে পড়বে। সব কষ্ট বৃথা যাবে।
নাটোরের সিংড়া উপজেলার সাতপুকুরিয়া গ্রামের এই কৃষকের আশঙ্কা অমূলক নয়। সিংড়ার চলনবিলে কয়েক দিন আগে কালবৈশাখী ও শিলাবৃষ্টিতে ধানের ক্ষতি হয়। এবার ধান হয়েছে প্রচুর। কিন্তু পাকা ধান ঘরে উঠবে কি না, তা নিয়ে কৃষকের শঙ্কা রয়ে গেছে। গতকাল শনিবার চলনবিলের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে মাঠে মাঠে সোনালি ফসল আর এই ফসল ঘিরে কৃষকের শঙ্কার কথা শোনা গেল।
চলনবিলে মাইলের পর মাইল ছড়িয়ে আছে সোনালি ধান। যেন দিগন্তজোড়া সোনালি কার্পেট। মাঠজুড়ে সোনালি রঙের ঝিলিক। বাতাসে ভাসছে পাকা ধানের মিষ্টি গন্ধ। চলনবিলে শুরু হয়েছে চলতি মৌসুমের ইরি-বোরো ধান কাটা ও মাড়াইয়ের উৎসব। তবে বিরূপ আবহাওয়ার পাশাপাশি ন্যায্য মূল্য নিয়েও চিন্তিত চাষিরা। তারপরও আশা ছাড়ছেন না তাঁরা। তবে বেশি পারিশ্রমিক ও শ্রমিকসংকটের কারণে চাষিরা তড়িঘড়ি করে ধান কেটে ঘরে তুলতে পারছেন না।
সিংড়ার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি ইরি-বোরো মৌসুমে চলনবিলের সিংড়া এলাকায় ৩৭ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে ইরি-বোরো ধানের চাষ করা হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৮ হাজার ৫৮৫ মেট্রিক টন। কৃষি কর্মকর্তারা আশা করছেন, বিপত্তি না ঘটলে ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে।
সিংড়ার চৌগ্রাম, জামতলী, শেরকোল, সাতপুকুরিয়াসহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, স্থানীয় মানুষ ও বাইরে থেকে আসা শ্রমিকেরা দল বেঁধে পাকা ধান কাটছেন। মাঠের সব জমির ধান এখনো সম্পূর্ণ পাকেনি। যেসব জমির ধান পেকেছে, চাষিরা সেই জমির ধান আগে কাটছেন। অনেক জমিতে এখনো পানি জমে আছে। পানিতে দাঁড়িয়ে চলছে ধান কাটা। দুপুরের পরপরই কাটা ধান মাথায় করে নির্ধারিত স্থানে নিয়ে জমা করা হচ্ছে। সেখান থেকে মহিষের গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি ও যন্ত্রচালিত গাড়িতে করে ধান মাড়াইয়ের জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেখানে মাড়াই যন্ত্রে মাড়াই করে ধান শুকানো হচ্ছে। শুকনো ধান বস্তাভর্তি হয়ে চলে যাচ্ছে কৃষকের বাড়িতে।
কৃষক পরিবারের নারী-পুরুষ সবাই মাঠে কাজ করছেন। পুরুষেরা শ্রমিকদের সঙ্গে ধান কাটতে ব্যস্ত। নারীরা ব্যস্ত ধান শুকানোর কাজে। সবাই যেন যন্ত্রের মতো কাজ করে যাচ্ছেন।
বেড়াবাড়ি গ্রামের কৃষক মশিউর রহমান বলেন, ‘ধান কাটতে শ্রমিকদের মণপ্রতি ৫ কেজি ধান ও তিন বেলা খাতি দিতে হয়। জমি থ্যাকি ধান টানা ও মাড়াই বাবদ চলি গ্যাছে মণপ্রতি ১০ কেজি। বাদবাকি যা থাকছে, তা দিয়ে খরচের টাকাই উঠছে না।’
চৌগ্রামের আতাউর রহমান বলেন, ‘ধান লাগানো, সার-বীজ কেনা, সেচ ও পরিচর্যা বাবদ প্রতি মণ ধানের উৎপাদন খরচ হয়েছে ৮০০ টাকা। তাই মণপ্রতি ধানের দাম ১ হাজার টাকা না হলে লোকসান হবি। এসব কথা চিন্তা করলে জমি থ্যাকি ধান কাটতেই ইচ্ছা করছে না।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেন জানান, চলতি মৌসুমের মাঝখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আগাম জাতের কিছু (মিনিকেট) ধানে চিটা হয়েছে। তবে অন্যান্য ধান ভালো হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে ধান উৎপাদনে কৃষকের লোকসান হবে না।
কৃষকদের ধান পাকার পরপরই কেটে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ধানের বাজারমূল্য সম্পর্কে সাজ্জাদ হোসেন জানান, সরকারিভাবে ধান কেনা শুরু হলে বাজারে ধানের দাম বাড়বে। কৃষকদের চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।