চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার মুহাম্মদ ইউনুস মিয়া এইচএসসি উত্তীর্ণ হয়েছিলেন ১৯৮০ সালে। ইচ্ছে ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবেন। কিন্তু তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অল্প কয়েকটি বিভাগে সীমিত আসন থাকায় তা পূরণ হয়নি। আর পারিবারিক কারণে উচ্চশিক্ষার জন্য চট্টগ্রামের বাইরেও যাওয়া হয়নি তাঁর। পরে স্থানীয় একটি কলেজ থেকে বিএসসি (পাস) ডিগ্রি নেন তিনি।
৩২ বছর পর ২০১২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে ভর্তি হয়ে বাবার অপূর্ণ ইচ্ছা পূরণ করেন তাঁর মেয়ে ফারজানা আফরীন। এখন তিনি চাকরি করছেন আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থায় (আইওএম)।
মুহাম্মদ ইউনুস মিয়ার মতো চট্টগ্রামের অনেকেই একসময় ইচ্ছা থাকলেও উচ্চশিক্ষা অর্জনের সুযোগ পাননি। কারণ, এই অঞ্চলে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল কয়েকটি বিভাগ ও সীমিতসংখ্যক আসন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ মিলত না সবার। এতে অনেকেরই শিক্ষাজীবন থেমে যেত। আবার কেউ কেউ বাধ্য হয়ে স্নাতক পাস কোর্সে ভর্তি হতেন।
তবে গত ৩০ বছরে চট্টগ্রামে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের চিত্র পুরোটাই পাল্টে গেছে। বর্তমানে পাবলিক ও বেসরকারি মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় আছে ১৫টি। পড়াশোনা করছেন প্রায় ৭০ হাজার শিক্ষার্থী। ফলে উচ্চশিক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দুশ্চিন্তা কমেছে।
উচ্চশিক্ষার সুযোগ বেড়েছে
১৯৯২ সালের আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছিল এখানকার একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়। ওই বছর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম (ইউএসটিসি) নামে চট্টগ্রামে প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন দেশের প্রথিতযশা চিকিৎসক ও জাতীয় অধ্যাপক নুরুল ইসলাম। ২০০৮ সালে চট্টগ্রামে যাত্রা শুরু করে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন। যেখানে পড়ছেন দেশ-বিদেশের ছাত্রীরা।
অবশ্য ২০০০ সালের পর সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে চট্টগ্রামে একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এখন সব মিলিয়ে পাঁচটি পাবলিক, নয়টি বেসরকারি ও একটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর প্রথম বর্ষে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছেন প্রায় ২০ হাজার শিক্ষার্থী।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উচ্চশিক্ষার নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন ও চেয়ারম্যান এ বি এম আবু নোমান ছিলেন অনুষদের প্রথম ব্যাচের ছাত্র। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ৩০ বছর আগে এই অঞ্চলে উচ্চশিক্ষার জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না। ফলে এখানে সুযোগ না পেলে অনেকের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন অধরা থেকে যেত। এখন অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নিত্যনতুন অনেক বিভাগ খোলা হচ্ছে। ফলে উচ্চশিক্ষা অর্জনে শিক্ষার্থীদের সুযোগ বেড়েছে।
১৩ বছরে শিক্ষার্থী বেড়েছে তিন গুণ
১৯৬৬ সালে চারটি বিভাগ ও ২০০ শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের। প্রতিষ্ঠার ৫২ বছর পর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৬টি বিভাগে অধ্যয়ন করছেন ২৮ হাজার শিক্ষার্থী।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও শিক্ষার্থী বেড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৫ সালে চট্টগ্রামের দুটি পাবলিক ও ৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ছিল ২৫ হাজার ৭৮০ জন। শিক্ষক ছিলেন ১ হাজার ৫২১ জন। এখন ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন ৭০ হাজার ১৫৪ শিক্ষার্থী। তাঁদের মধ্যে ছাত্র ৪৫ হাজার ৪২৩ জন ও ছাত্রী ২৪ হাজার ৭৩১ জন। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন ৩ হাজার ৪৩৫ শিক্ষক।
এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর উত্তীর্ণ হচ্ছেন ১৫ হাজারের বেশি ছাত্রছাত্রী। তাঁরা সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পদে যোগ দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেছেন। অনেকে শিক্ষকতার পাশাপাশি উচ্চতর শিক্ষা অর্জনের জন্য যাচ্ছেন বিদেশে। গবেষণা আর চাকরিতে রাখছেন কৃতিত্বের স্বাক্ষর।
১৯৮৫ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছিলেন চট্টগ্রামের সরকারি কমার্স কলেজের অধ্যক্ষ আইয়ুব ভূঁইয়া।
তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখন অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে উচ্চশিক্ষা নিয়ে আগ্রহ বেড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নানা বিষয়ের ওপর বিভাগ থাকায় শিক্ষার্থীদের কাছে প্রচুর বিকল্প আছে।
মসৃণ ছিল না উচ্চশিক্ষার যাত্রা
চট্টগ্রামে উচ্চশিক্ষার এখন যে অগ্রযাত্রা, শুরুর পথটা এত মসৃণ ছিল না। এই অঞ্চলে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হয়েছে। ১৯৪০ সালেই চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি ওঠে। ২৬ বছর পর ১৯৬৬ সালে এসে এই দাবি পূর্ণতা পায়। একইভাবে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি কলেজ এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিকে (বিআইটি) বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেছিলে নাগরিক সমাজ ও শিক্ষার্থীরা, পরে যা বাস্তব রূপ পায়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলে বিকশিত হয়েছে উচ্চশিক্ষা। দেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছিলেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের জোবরা গ্রামে শুরু করেছিলেন ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি, যা এখন বিশ্বের অন্যতম আলোচিত বিষয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়েই অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী প্রয়াত ড. জামাল নজরুল ইসলাম। চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠন-পাঠনে জড়িত ছিলেন অনেক গুণী শিক্ষক ও শিক্ষার্থী।
২০১৬ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ সমাবর্তনে ইউজিসি চেয়ারম্যান ও সাবেক উপাচার্য আবদুল মান্নান বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে সারা দেশেই একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এখানকার ছাত্রছাত্রীরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাফল্য দেখিয়েছেন এবং এখনো তাঁদের এই ধারা অব্যাহত আছে। বর্তমান বিশ্বের যুগোপযোগী শিক্ষার মানোন্নয়নে এটি ইতিমধ্যে সব মহলের স্বীকৃতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
চালু হচ্ছে যুগোপযোগী বিভাগ
ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, দেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৯টির মধ্যে ৫টি, ১০৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৯টি এবং ৩টি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ১টির অবস্থান চট্টগ্রামে। প্রথাগত বিষয়ের পাশাপাশি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে খোলা হচ্ছে বিভিন্ন বিভাগ।
সমুদ্র অর্থনীতিকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্স অ্যান্ড ফিশারিজ ইনস্টিটিউটকে অনুষদে রূপান্তর করা হয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউট। খোলা হয়েছে অপরাধতত্ত্ব, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা, সংগীত ও নাট্যকলা বিভাগ। চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ে আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে বায়োটেকনোলজি ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এবং পরিবেশবিজ্ঞান অনুষদে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে। চুয়েটে আগামী বছর চালু হচ্ছে নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং, মেটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ। এ ছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রতিবছর যুক্ত হচ্ছে একাধিক নতুন বিভাগ।
উচ্চশিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য সময়োপযোগী বিভাগ চালু এবং গবেষণার বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গবেষণা থেকে অর্জিত জ্ঞান শিক্ষার্থীদের সমৃদ্ধ করবে। আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানের ভারসাম্য যাতে নষ্ট না হয়, সে জন্য তদারকি নিশ্চিত করতে হবে।
উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে ভিন্নমত
চট্টগ্রামে উচ্চশিক্ষার মান, এর সুযোগ-সুবিধা ও প্রাপ্তি নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান ও পড়াশোনা নিয়ে তেমন কোনো অভিযোগ নেই তাঁদের। যথাসময়ে ক্লাস-পরীক্ষা আয়োজনের ব্যাপারে আগের তুলনায় প্রশাসনের তদারকি বেড়েছে বলে জানান। অভিভাবকদের সঙ্গেও যোগাযোগ বেড়েছে কর্তৃপক্ষের। সেশনজট কমেছে। তবে গবেষণা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তাঁরা। এই খাতের উন্নয়ন না হলে উচ্চশিক্ষার সুফল পুরোপুরি পাওয়া যাবে না বলে উল্লেখ করেন শিক্ষার্থীরা। আর আবাসন-যাতায়াত নিয়ে সমস্যা রয়ে গেছে।
তবে চট্টগ্রামে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্র বাড়লেও মান নিয়ে প্রশ্ন আছে শিক্ষাবিদদের মধ্যে। অনেকে মনে করছেন, শিক্ষার মান কমছে। উচ্চশিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য চলছে। এতে বৈষম্যও সৃষ্টি হচ্ছে। এই রকমই বলেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ইউজিসি অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম।
ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতকোত্তর করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন অধ্যাপক মুহাম্মদ
সিকান্দার খান। বর্তমানে তিনি ইস্ট ডেল্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গত ৩০ বছরে চট্টগ্রামের উচ্চশিক্ষায় গুণগত
অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসর অনেক বেড়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি অনেকগুলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন নতুন একাধিক বিভাগ চালু হচ্ছে। আর এসব বিশ্ববিদ্যালয় না হলে চট্টগ্রামের বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতেন। তখন একধরনের সমস্যার সৃষ্টি হতো।