>নাসরিন বাকীর প্রতিষ্ঠা করা হাসপাতালে এই কার্যক্রম পরিচালনা করবে আল মানাহিল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন, শয্যা আছে ৭০টি
আশপাশের পঙ্গু আর দুস্থ মানুষদের অসহনীয় কষ্ট বেশ ভাবাত নাসরিন বাকীকে। এসব মানুষের জীবনযন্ত্রণা হৃদয় দিয়ে অনুভব করতেন। অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানোর একটা তাগিদ ছিল নিজের মধ্যে। বাধাও কম ছিল না। তবে দমে যাননি তিনি। ইচ্ছাশক্তির জোরে ঠিকই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেন তিনি।
চট্টগ্রামের হালিশহরের ফুল চৌধুরীপাড়ায় নাসরিন বাকী গড়ে তুলেছিলেন নার্চার হাসপাতাল। যেখানে পঙ্গু ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষদের সেবা দেওয়া হতো। ১৯৯৪ সালের ১ এপ্রিল টিনের ঘরে শুরু হয়েছিল চিকিৎসাসেবা। পরে দিনে দিনে এই হাসপাতাল পাকা ছয়তলা ভবনে উন্নীত হয়। সেবার পরিধিও বাড়ে ক্রমান্বয়ে। ধীরে ধীরে চট্টগ্রামসহ আশপাশের জেলার পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষের বড় ভরসার জায়গা হয়ে দাঁড়ায় এ হাসপাতাল।
নাসরিন বাকীর প্রতিষ্ঠিত এ হাসপাতালে এখন করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আল মানাহিল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ করোনা রোগীদের সেবা দিতে হাসপাতাল প্রস্তুতির কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এতে ৭০টি শয্যা রয়েছে। এখানে অক্সিজেনের সুবিধাও থাকবে।
হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে নাসরিন বাকী বলেন, ‘বাবা ব্যারিস্টার সলিমুল হক খান মিলকির কথা, “মানুষ যেখানেই থাকুক না কেন, এটা তাঁর কর্তব্য যে তিনি কেবল নিজের অধিকারের কথা ভাববেন না, তাঁর পাশের লোকটির, তাঁর বাড়ির পাশের পরিবারের কথাও ভাববেন। আমাদের বুঝতে হবে, এই দেশের মাটিতে আমার যে অধিকার, ওই ফুটপাতে শুয়ে থাকা লোকটিরও যে তেমনি অধিকার” কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে “আমার টাকা আছে আমি চিকিৎসা পাব, আর একজন গরিব মানুষ বিনা চিকিৎসায় রাস্তাঘাটে পড়ে মারা যাবে, এটা হওয়া উচিত না” ভাবনায় “নার্চার” হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু করি।’
চট্টগ্রাম ড্রাই ডকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এনামুল বাকী ও হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা নাসরিন বাকী দম্পতির যমজ ছেলে ইয়ামিন বিন বাকী ও ইয়াসির বিন বাকী কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে পেশাগত কাজে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। একমাত্র মেয়ে সানজানা নামরিনও এখন পড়ছেন যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ছেলেমেয়েদের দেখতে ও পারিবারিক কারণে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া-আসা করতে হয় এই দম্পতিকে। তাই হাসপাতালের পরিচালনার কাজ আরও সক্রিয়ভাবে করার জন্য ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে আল মানাহিল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনকে বিনা মূল্যে চিকিৎসা নিশ্চিতে হাসপাতাল ভবন বিদ্যমান সুবিধাদিসহ এবং সংলগ্ন জমিও দান করা হয়, ভবিষ্যৎ সম্প্রসারণের নিমিত্তে। ফাউন্ডেশন আরও বৃহৎ পরিসরে সেখানে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এর মধ্যে করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ায় আপাতত কোভিড রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
আল মানাহিল কর্তৃক কোভিড হাসপাতাল পরিচালনার প্রসঙ্গে নাসরিন বাকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘মহামারির কালে হাসপাতালটি মানুষের পাশে দাঁড়াবে, ফ্রি চিকিৎসাসুবিধা নিশ্চিত করবে জেনে খুবই ভালোই লাগছে। মানাহিল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের উদ্যোগকে স্বাগত জানাই এবং বিনা মূল্যে সাধারণ মানুষের চিকিৎসা নিশ্চিতে তাদের প্রয়াসের সার্বিক সাফল্য কামনা করি।’
হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার ইতিহাস
চট্টগ্রামের মেয়ে নাসরিন বাকী সেন্ট স্কলাসটিকা ও চট্টগ্রাম কলেজে পড়াশোনা করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। এরপর বিয়ে, যমজ সন্তান। পরিবার-সংসার সামলানোর মধ্যেও অসহায় পঙ্গু ও দুস্থ মানুষদের জীবনযন্ত্রণার কথা ভাবতেন। এ চিন্তা থেকে হাসপাতাল করার পরিকল্পনা আসে। কিন্তু সে স্বপ্ন বাস্তবায়নে অনেক অর্থের প্রয়োজন। কেউ কেউ নিরুৎসাহিত করেছিলেন।
পেছনে ফিরে তাকাননি নাসরিন। টিনের ঘর করে চালু করেন স্বপ্নের ‘নার্চার’।
হাসপাতালের অর্থ জোগাড়ের জন্য করেছিলেন বিউটি পার্লার। সে আয়ের টাকা খরচ করেছেন রোগীদের সেবায়। পরামর্শের জন্য ছুটে গিয়েছিলেন ঢাকার সিআরপির ভ্যালেরি অ্যান টেইলরের কাছেও। একসময় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। দেশ-বিদেশের বিখ্যাত চিকিৎসকেরা এ হাসপাতালে সেবা দিয়ে গেছেন।