সদর উপজেলা থেকে দৌলতখানের মদনপুরে যেতে দুটি নৌপথ। প্রতিদিন সহস্রাধিক মানুষ যাতায়াত করে।
‘জনপ্রতি ৩০ টাকা, সঙ্গে আছে মালের ভাড়া। কিন্তু খেয়ানৌকায় (ট্রলার) যাত্রী ওঠানো–নামানোর কোনো ঘাট নেই। সব সময় যাত্রীদের কাদা-পানি ভেঙে নৌকায় ওঠানামা করতে হয়। এই চরে (ভোলার দৌলতখান উপজেলার মদনপুর) অনেকবার এমপি (সাংসদ), ইউএনও, ডিসি (জেলা প্রশাসক) এসেছেন। কিন্তু চরের যাত্রীদের ভোগান্তি কমেনি। দিন দিন ভোগান্তি বাড়ছে।’ কথাগুলো বলছিলেন মদনপুর ইউনিয়নের চরপদ্মা গ্রামের বাসিন্দা লুৎফুর রহমান পাটওয়ারী (৭০)। তিনি ভোলার সদর উপজেলা সাবরেজিস্ট্রারের কার্যালয়ের দলিল লেখক। তাঁকে নিয়মিত কর্মস্থলে যেতে হয়।
সদর উপজেলা থেকে দৌলতখান উপজেলার মদনপুর ইউনিয়নে যেতে দুটি নৌপথ। একটি নাছিরমাঝি (সদর)-চেয়ারম্যানবাজার (দৌলতখান)। অন্যটি তুলাতুলি (সদর)-করাতির খাল (শিকদার বাড়ির দরজা-দৌলতখান) নৌপথ। প্রতিদিন দুটি নৌপথে সহস্রাধিক মানুষ যাতায়াত করে।
জেলা প্রশাসকের স্থানীয় সরকার শাখা ও ইউনিয়ন পরিষদ সূত্র জানায়, এ দুটি ঘাট বছরে প্রায় ১৫ লাখ টাকায় ইজারা দেওয়া হয়।
৪ অক্টোবর দৌলতখান উপজেলার মদনপুর ইউনিয়নে যাওয়ার পথে দেখা যায়, যাত্রীদের দুর্ভোগের শেষ নেই। ভোলা শহর থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার পূর্বে তুলাতুলি মেঘনা তীরে নির্ধারিত কোনো খেয়াঘাট নেই। যখন যেমন সুবিধা, সেখানে খেয়ানৌকা সেভাবেই নোঙর করছে ও ছাড়ছে। জোয়ার-জলোচ্ছ্বাসে বাঁধের পরে নৌকায় ওঠার পথ ধসে গেছে। যাত্রীদের অনেকখানি পথ ঘুরে নৌকায় ওঠার পথ খুঁজতে হচ্ছে। ভাটার কারণে নৌকা নদীর অনেক নিচে। সিমেন্টের ব্লকে শেওলা পড়া পিচ্ছিল পথ। একটু অসাবধানে পা ফসকালেই বড় দুর্ঘটনা। এ ঘাটে নৌকায় ওঠার কোনো সিঁড়ি বা ঘাট নেই।
ঘাট থেকে ট্রলারে ওঠার পরও স্বস্তি নেই যাত্রীদের। বাধ্য হয়ে ময়লা-নোংরার মধ্যে বসতে হচ্ছে তাদের। অনেকে ঝুঁকি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। থেমে থেমে বৃষ্টি পড়তে থাকে। যাত্রীদের অনেকের কাছে ছাতা নেই। তারা ভিজতে থাকে। নদীতে পানি কম। হঠাৎ ট্রলারটি মদনপুরের (মেঘনার মাঝে জেগে ওঠা একটি ইউনিয়ন) সীমানায় ডুবোচরে আটকে যায়। যাত্রীদের পড়ে যাওয়ার অবস্থা। পাটনি (মাঝি) মো. কামাল যাত্রীদের ট্রলার থেকে নেমে যেতে বলেন।
উত্তর-দক্ষিণ বরাবর লম্বা ডুবোচর। হাঁটুপানির মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে মেঘনার ডুবোচর পেরোলে আরেকটি খেয়ানৌকা। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একই রুটের দুলাল মাঝির ট্রলার। অনেকটা বাদুড় ঝোলার মতো, কাদা–পানি মেখে দুলালের ট্রলারে চড়ল যাত্রীরা। সেখান থেকে ট্রলার গেল করাতির খালে। খালে পানি কম, ঘাট নেই। হাঁটুসমান কাদা ভেঙে শিকদার বাড়ির দরজায় ইটের সড়কে যাত্রীরা উঠল।
দুলাল মাঝি জানান, ভাটার সময় ডুবোচর ভেসে ওঠে। এ সময় ভোগান্তি হয়। সদ্য জেগে ওঠা ডুবোচরটি কেটে না দিলে যাত্রীদের ভবিষ্যতে দুর্ভোগ আরও বাড়বে।
তুলাতুলি-করাতির খাল ঘাটের ইজারাদার আসলাম গোলদার বলেন, তুলাতুলি ঘাট উপজেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এখানে নোয়াখালী, মতিরহাট, মদনপুর-কাচিয়ার ট্রলার ছেড়ে যায়। এখান থেকে একসময় ঢাকার লঞ্চ ছাড়ত। কিন্তু এখানে কোনো স্থায়ী ঘাট নির্মাণ করা হয়নি। ঘাট নির্মিত হয়নি দৌলতখানের মদনপুর করাতির খালের তীরেও। যাত্রীরা কাদা–পানির সঙ্গে নাকানিচুবানি খেয়ে নদী পার হচ্ছে। ঘাট না থাকার কারণে নৌকা পরিচ্ছন্ন থাকে না।
তুলাতুলি-করাতির খাল নৌপথের মতো একই সমস্যা নাছিরমাঝি-চেয়ারম্যানবাজার নৌপথে।
এ ঘাটের নিয়মিত যাত্রী মদনপুর আলোর পাঠশালার সহকারী শিক্ষক হেলাল উদ্দিন। তিনি বলেন, সদর উপজেলার নাছিরমাঝি ঘাটে পাকা ব্লক থাকার কারণে একটু সাবধানে ওঠানামা করতে হয়। অন্য সমস্যা তেমন নেই। কিন্তু দৌলতখানের চেয়ারম্যানবাজার ঘাটে সব সময় জুতা খুলে, প্যান্ট-কাপড় তুলে কাদার মধ্যে দিয়ে ঘাট পার হতে হয়। অনেকেই পিছলে পড়ে কাদায় মাখামাখি হয়। এখানে ভাঙনের মুখে বালুভর্তি বস্তা ফেলে একটি পাকা ঘাট নির্মাণ করা জরুরি।
ইউপি সদস্য ফারুক দৌলত বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে আমরা দৌলতখান উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়ে একটি পাকা ঘাটের জন্য আবেদন করে আসছি। আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। যদিও সরকার প্রতিবছর এ দুটি ঘাট থেকে অনেক টাকা ইজারা নিচ্ছে।’
ভোলার আন্ত–উপজেলা খেয়াঘাটগুলো ইজারা হয় জেলা প্রশাসনের স্থানীয় সরকার শাখা থেকে। স্থানীয় সরকার শাখার উপপরিচালক (ডিডিএলজি) রাজিব আহমেদ বলেন, ‘খোঁজ নিয়ে দেখি, কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায় কি না।
জেলা প্রশাসক (ডিসি) তৌফিক ই-লাহী চৌধুরী বলেন, ‘ঘাটই যদি না থাকে, তাহলে ইজারা দিয়ে লাভ কী? খোঁজ নিয়ে ঘাট উন্নয়নের চেষ্টা করব।’