বন্যা ও ঝড়ে সুনামগঞ্জের হাজারো পরিবারের বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার পানি নেমে যাচ্ছে। কিন্তু এখনো অনেকে ঘরে উঠতে পারেননি।
খালেদা বেগমের (৩৩) স্বামী নেই। দুই সন্তান আর শাশুড়িকে নিয়ে ছোট একটি টিনের ঘরে বাস করতেন। বন্যা ও ঝড়ে ঘরের চাল, বেড়া ও মেঝে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ কারণে এখনো তাঁরা আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন। ঘরের যে সংস্কার করবেন, সেই টাকাপয়সা নেই। তাই ঘর সংস্কারের জন্য সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি। খালেদা বেগমের বাড়ি সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সুলতানপুর গ্রামে।
এবারের বন্যা ও ঝড়ে খালেদা বেগমের মতো সুনামগঞ্জের হাজারো পরিবারের বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশই দরিদ্র পরিবার। অনেকে আছেন আশ্রয়কেন্দ্র। আবার অনেকে আছেন স্বজনদের বাড়িতে। তাঁরা ঘর সংস্কার করে বসবাসের উপযোগী করে তোলার জন্য সরকারি সহায়তা পাওয়ার আশা করছেন।
ঘরে উঠতে না পারার বিষয়ে খালেদা বেগম জানালেন, ‘আমার স্বামী ঘরটি বানিয়েছিলেন। এখন আমি অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাই। বন্যার কারণে যেতে পারছি না। হাতে টাকাপয়সাও নেই। খাওয়াদাওয়া নিয়েই চিন্তায় আছি। আমার এখন ঘর ঠিক করার মতো অবস্থা নেই।’
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সুলতানপুর গ্রামে এলাকার বাসিন্দা মরম আলী বলেন, ‘দিনমজুরি করি খাই। বন্যার সময় হাওরের বড় বড় ঢেউয়ে ঘরের বেড়া ভাঙছে। কিছু টিন পাইলে কাজ করতাম। সরকারি কইছে দিব। সেই অপেক্ষাত আছি।’
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, এবারের বন্যা ও ঝড়ে সুনামগঞ্জে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘরের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে সেটি করা হচ্ছে। এসব ঘরবাড়ি সংস্কারের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে ছয় হাজার বান্ডিল ঢেউটিন চেয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।
সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নাদের বখত জানিয়েছেন, বন্যায় কেবল পৌরসভার বিভিন্ন এলাকায় অন্তত দুই হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার পানি নেমে যাচ্ছে। এখন মানুষের ঘর সংস্কার করা জরুরি। অনেকেই আসছেন সহায়তার জন্য। কিন্তু এখন পর্যন্ত পৌরসভা কোনো বরাদ্দ পায়নি।
উজান থেকে নামে আসা পাহাড়ি ঢলে ১৪ মে প্রথমেই দোয়ারাবাজার উপজেলা সদরের দক্ষিণ বড়বন গ্রামে ১১টি বসতঘর ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব পরিবারের মধ্যে পাঁচটি পরিবার আবার ঘরগুলো সংস্কার করেছে। বাকি ছয়টি দরিদ্র পরিবারের ঘরগুলো পুরোপুরি ভেঙে গেছে। তাই তারা এখনো এলাকার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আছে।
দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেবাংশু কুমার সিংহ বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। ঢলে ঘরহারা ছয়টি পরিবারকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
১৪ মে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার সলুকাবাদ ইউনিয়নের ভাদেরটেক গ্রামের ১২টি পরিবারের ঘর ভেঙে যায়। এসব পরিবারের মধ্যে কেউ কেউ খুপরি তুলে আবার কেউ কেউ আত্মীয়ের বাড়িতে আছেন। ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত ভাদেরটেক গ্রামের বাসিন্দা মোহন মিয়া বলেন, ‘আমরা দরিদ্র মানুষ। এবার বন্যায় ধানের সাথে ঘরও গেছে। এখন দিনমজুরি করি। কাজ পাইলে খাই, কাজ না পাইলে না খেয়ে দিন যায়। ঘর বানাইবার কোনো সামর্থ্য নাই।’
সলুকাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নুরে আলম বলেন, শুধু পাহাড়ি ঢলে নয়, বন্যায় অনেকের ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়েছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের তালিকা উপজেলা প্রশাসনের কাছে জমা দিয়েছি। সরকারি সহায়তা এলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা তা পাবেন।’
সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, ‘সুনামগঞ্জে বন্যা হলে হাওরের ঢেউয়ে মানুষের ঘরবাড়ির ক্ষতি হয় বেশি। এবার একদিকে বন্যা, অন্যদিকে ছিল ঝড়। এ কারণে ক্ষতি হয়েছে বেশি। আমরা চাই ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেকেই যেন সরকার থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা পায়।’
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম জানান, জেলায় বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের কাজ চলছে। পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেতে কিছুটা সময় লাগবে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ঘরবাড়ি সংস্কারের জন্য বরাদ্দ এলে সেটি তাঁরা পাবেন।
সুনামগঞ্জে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হয়েছে। মানুষের বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট থেকে পানি নামছে। আশ্রয়কেন্দ্র থাকা বেশির ভাগ মানুষই বাড়িতে ফিরেছে। তবে নিচু এলাকায় এখনো কিছু বাড়িঘর ও রাস্তাঘাটে পানি আছে। পানি নামায় প্লাবিত হওয়া স্কুল ও কলেজে আবার পাঠদান চলছে।