টিনের ঘরের ভেতরে বসে টিভি দেখছিলেন ৫০ বছর বয়সী দীপ্তি রানী কর। টেলিভিশনে সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি ও আবহাওয়া বার্তায় কী বলা হচ্ছে, তা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন তিনি। সঙ্গে ছোট ছোট দুই নাতি–নাতনি। একটু পর খালি কলস নিয়ে ঘরে ঢুকলেন দীপ্তি রানীর পুত্রবধূ পপি রানী কর। জানালেন, পাশেই একটি মুড়ির কারখানা থেকে পানি আনতে গিয়েছিলেন তিনি। সেখান থেকে জানানো হয়েছে, সন্ধ্যায় পানি দেওয়া হবে।
সিলেট নগরের চালিবন্দর এলাকার দীপ্তি রানীদের টিনের চালার ঘরটিতে প্রবেশ করতে কাদাপানি মাড়িয়ে আসতে হয়। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, ঘর ও বাড়ির আঙিনার সব পানি নামার জন্য আরও সময় লাগবে। ঘরের ভেতরে একটি কক্ষে আজ সোমবার দুপুরেও দেখা গেছে হাঁটুপানি। অন্য তিনটি কক্ষের পানি নেমেছে বটে, তবে শুকায়নি। দীপ্তি রানীর প্রতিবেশী আরও ১৫-১৭টি পরিবারের চিত্রও একই রকম।
প্রায় এক সপ্তাহ আগে স্থানীয় রামকৃষ্ণ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে সিটি করপোরেশনের আশ্রয়কেন্দ্রে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ছিলেন দীপ্তি রানী। ঘরে তখন কোমরপানি ছিল। আজ সকালেই ঘরে ফিরেছেন তাঁরা। ঘরে ফিরলেও ভয় কাটেনি, কবে আবার পানি উঠবে; সে চিন্তায় দিন কাটছে তাঁদের। আশ্রয়কেন্দ্রে কিছু মালামাল নিয়ে গিয়েছিলেন। সেগুলোর কিছু নিয়ে এসেছেন। আরও কিছু মালামাল আশ্রয়কেন্দ্রে রয়ে গেছে। সকালে ঘরে ফিরে মেঝেতে থাকা পানি পরিষ্কার করে ফ্যান ছেড়ে শুকিয়ে নিয়েছেন বলে জানালেন দীপ্তি রানী।
সপ্তাহখানেক পর ঘরে ফিরে পপি রানী সবকিছু গোছাতে ব্যস্ত। বিছানাপত্র গুছিয়ে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে আনা মালপত্র জায়গামতো রাখছিলেন। ঘরের একটি কক্ষে রাখা পানির পাত্রগুলো দেখিয়ে পপি রানী বললেন, সিটি করপোরেশনের পানির সরবারহ বন্ধ। ব্যবহারের পানি তো দূরের কথা, খাবার পানিও নেই। এখন প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে পানি আনতে হয়। এমন অবস্থায় দিন কাটাতে হচ্ছে।
পুত্রবধূর কথার সঙ্গে যোগ করে দীপ্তি রানী বলেন, আশ্রয়কেন্দ্রে থাকার সময় চিড়া, মুড়ি ও গুড় দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রান্না করা খাবারের মধ্যে রাতে খিচুড়ি দেওয়া হতো। এর বাইরে কোনো সহায়তা পাননি। বন্যার কারণে অর্থসংকটে পড়ে গেছে পরিবারটি। দীপ্তি রানীর স্বামী উজ্জ্বল কর চা–দোকান চালান। ছেলে সুজন করও ব্যবসা করেন। তবে বন্যার কারণে এক সপ্তাহ ধরে ব্যবসা নেই। এমন অবস্থায় তাঁদের আগের জমানো টাকা দিয়েই চলছিল। এখন সে টাকাও শেষ। ব্যবসা আবার চালু করার এবং সংসার চালানোর টাকা কোথা থেকে আসবে, সে চিন্তা ঘিরে ধরেছে পরিবারটিকে।
দীপ্তি রানী বলেন, ‘প্রায় ৩৫ বছর ধরে এখানে (চালিবন্দর) আছি। ছড়ার কাছে বাড়ি হওয়ায় প্রায়ই বৃষ্টি মৌসুমে পানি ওঠে। কিন্তু এভাবে ঘর ছেড়ে যেতে হয়েছে মাত্র একবারই। এবার দ্বিতীয়বারের মতো ঘর ছেড়ে দিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠতে হয়েছে। রাতে আবার আশ্রয়কেন্দ্রে যাব। তবে পুত্রবধূসহ অন্যরা ঘরেই থাকবে।’
গত মঙ্গলবার থেকে পাহাড়ি ঢল ও ভারী বৃষ্টিতে সুরমা নদীর পানিতে সিলেট নগরে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। পানি ঢোকে ঘরবাড়িতে। এতে নগরের প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যায়। গতকাল রোববার থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। তবে এখনো নগরের বিভিন্ন পাড়া–মহল্লা ও নিচু এলাকাগুলোতে পানি রয়ে গেছে। রয়ে যাওয়া পানি নর্দমার সঙ্গে মিশে কালো রং ধারণ করেছে। ছড়াচ্ছে পচা গন্ধ।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যে জানা গেছে, সিলেটে প্রধান দুটি নদীর পানি কমেছে। এর মধ্যে সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে গতকালের তুলনায় কমেছে দশমিক ১১ সেন্টিমিটার। নদীর সিলেট পয়েন্টে আজ বেলা ১২টার দিকে পানি বিপৎসীমার নিচে নেমেছে। ওই পয়েন্টে বেলা ১২টায় পানির পরিমাণ ছিল ১০ দশমিক ৭৮ সেন্টিমিটার। নদীর সিলেট পয়েন্টে বিপৎসীমা ধরা হয় ১০ দশমিক ৮০ সেন্টিমিটার। একই সময়ে কুশিয়ারা নদীর অমলশিদ পয়েন্টে পানির উচ্চতা ছিল ১৬ দশমিক ২৪ সেন্টিমিটার এবং শেওলা পয়েন্টে ছিল ১৩ দশমিক ৩৩ সেন্টিমিটার।