খেলার মাঠেই তারা খেলছে, সেখানে ফুটবল নেই, ক্রিকেট বল নেই, নেই কোনো খেলার সরঞ্জাম। তবু তারা মেতে আছে। তাদের হাতে হাতে স্মার্টফোন। একসময় তারা ভালো ফুটবল খেলত, ক্রিকেট খেলত। এখন তারা সেসব বাদ দিয়ে মেতেছে নতুন এই খেলায়।
শহরের বাচ্চারা স্মার্টফোন নিয়ে, গেমস নিয়ে বেশি মেতে থাকে—এমন সাধারণ ধারণা ছিল অনেকের মধ্যে। কিন্তু দেশে করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার সুযোগে বাস্তবতা পাল্টে গেছে। এখন পাড়াগাঁয়ের শিশু–কিশোর, তরুণেরাও স্মার্টফোনে গেমস নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যস্ত থাকছেন। সম্প্রতি রাজশাহী অঞ্চলের কয়েকটি গ্রাম ঘুরে ও স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেল।
স্মার্টফোনে কিশোর–তরুণদের আসক্তিকে শিক্ষার জন্য বড় বিপর্যয় বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদ ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা। এ জন্য অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। সঙ্গে বাচ্চাদের বেশি সময় দেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত রোববার বিকেলে নাটোরের রাধাকান্তপুর স্কুল ও কলেজ মাঠে একদল কিশোর–তরুণকে দেখা গেল। তাঁদের হাতে ১৫ থেকে ২৮ হাজার টাকা দামের স্মার্টফোন। তাঁরা সবাই ‘ফ্রি ফায়ার’ নামের একটি মোবাইল গেমস খেলায় ব্যস্ত। কথা বলে জানা গেল, বছরখানেক আগে যে তরুণ দল এই মাঠে ফুটবল ও ক্রিকেট নিয়ে মেতে থাকতেন, তাঁরা সবাই এখন স্মার্টফোন গেমসে মজেছেন।
দলটিতে তিনজন ক্রিকেট খেলোয়াড় ছিলেন। যাঁদের এলাকার বাইরে খেলার জন্য ভাড়া করে নিয়ে যাওয়া হতো। যে তরুণের হাতে ২৮ হাজার টাকার ফোন ছিল, তাঁর বাবা একজন দরিদ্র কৃষক। সেই বাবা ছেলেকে ফোন কিনে দিতে বাধ্য হয়েছেন। তরুণের ভাষ্য, এটা সমাজের একটা চল হয়ে গেছে। প্রতি মাসে মোবাইল ডেটা কিনতে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা খরচ হয় তাঁর। যে তরুণের হাতে ১৮ হাজার টাকার ফোন, তিনি জানান, গত চার-পাঁচ মাসে তিনি এর পেছনে ২০ হাজার টাকার মতো খরচ করেছেন। রাত ১০টা থেকে খেলা শুরু করে ভোরের আজান পর্যন্ত খেলেন তিনি। এখন মনে হচ্ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর তাঁরা মোবাইলে গেমস খেলতে না পারলে বোধ হয় মারাই যাবেন। তবে তিনি এ–ও স্বীকার করেছেন, এতে তাঁদের চোখের সমস্যা হচ্ছে।
একই দিন বিকেলে পাশের রাজশাহীর বাঘা উপজেলার শরীফবাদ কলেজ মাঠে ১৫ জনের একটি দল পাওয়া গেল। তারা স্মার্টফোন হাতে গেমস খেলায় মগ্ন ছিল। তাদের মধ্যে পীরগাছা গ্রামের নবম শ্রেণিপড়ুয়া এক শিক্ষার্থী বলে, তার বাবাও একজন কৃষক। তার হাতে সাড়ে ১৫ হাজার টাকার ফোন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার পর সে এই খেলা শুরু করেছে। প্রতি মাসে তার দেড় হাজার টাকা করে খেলার পেছনে খরচ হয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, তিনি শিক্ষা নিয়ে ৩০ বছর ধরে কাজ করেছেন। শিক্ষার এত বড় বিপর্যয় আর দেখেননি। স্মার্টফোনে শিক্ষার্থীদের আসক্তির ব্যাপারে তিনি বলেন, এতে শিক্ষার্থীদের মনোসামাজিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ জন্য অভিভাবকদের সচেতন থাকতে হবে। বাচ্চাদের সময় দিতে হবে। তারা যেন খেলাধুলা করতে পারে, সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। তিনি বলেন, পরিবারের এই সচেতনতা নিয়ে থাইল্যান্ডে একটা কাজ হয়েছে। তারা এটার নাম দিয়েছে ‘ফ্যামিলি ভ্যাকসিন’। ব্র্যাক ৩৫টি উপজেলায় পরিবারের সচেতনতা নিয়ে কাজ শুরু করেছে। তারা তিন ধরনের সচেতনতার কথা বলছে, তার মধ্যে একটি হচ্ছে শিশুর মনোসামাজিক বিকাশ। যে যার জায়গা থেকে এটা করা উচিত।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান ও বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কথাসাহিত্যিক মামুন হুসাইন বলছেন, তাঁরা এটাকে সেলফোন অ্যাডিকশন ও নন–ড্রাগ অ্যাডিকশন বলছেন। মাদক নয়, কিন্তু তাতে আসক্ত হচ্ছে। এ ধরনের প্রচুর রোগী তাঁরা পাচ্ছেন। অভিভাবকেরাই তাঁদের বাচ্চাদের নিয়ে আসছেন। আত্মীয়স্বজনও নিয়ে আসছেন। কারও আচরণগত সমস্যা দেখা দিয়েছে, কেউ পড়াশোনাবিমুখ হয়ে গেছে। সবকিছুর মূলেই স্মার্টফোন আসক্তি।
মামুন হুসাইন আরও বলেন, স্মার্টফোন আসক্তির কারণে তরুণদের স্বাভাবিক মানস গঠন ব্যাহত হচ্ছে। মানুষ শৈশব-কৈশোরে যা অর্জন করে, সারা জীবনে তা সে খরচ করে। এ সময় তাদের জীবনের যে বৈচিত্র্যময়তা বা সমাজ–সংলগ্নতা তৈরি হয়, এই আসক্তি তাতে গভীর বিপর্যয় তৈরি হচ্ছে এবং সমাজের সঙ্গে তাদের বিযুক্তি তৈরি করছে।
সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী মো. মাহফুজুর রহমান চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া ১০০ শিক্ষার্থীর ওপর তাঁরœম্নাতকোত্তর পর্যায়ের একাডেমিক গবেষণা করেছেন। তিনি দেখেছেন, স্মার্টফোন গেমসে আসক্ত প্রায় ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীর সামাজিক আচরণ খারাপ, অল্পতেই উত্তেজিত হওয়া, পড়াশোনা ও খেলাধুলায় অমনযোগিতা এসেছে। তাদের চোখের সমস্যা ও কাজকর্মে আলস্যবোধ তৈরি হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলা স্টেডিয়ামের পাশে, তানোরে রাস্তার মোড়ে মোড়ে, দুর্গাপুর পশু হাসপাতালের মোড়ের সরকারি ওয়াই–ফাই পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে শিক্ষার্থীরা স্মার্টফোনে গেমস খেলছে।
রাজশাহী সুশিক্ষা আন্দোলন মঞ্চের আহ্বায়ক নগরের লক্ষ্মীপুর বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. ফারুক হোসেন বলেন, শিক্ষার্থীরা গেমসে আসক্ত হয়ে ঠিকমতো খাওয়া-গোসল পর্যন্ত করছে না। তাঁর নিজ গ্রাম রাজশাহীর গোদাগাড়ীর প্রসাদপাড়ায় তরুণদের এই অবস্থা দেখে তিনি পুলিশ পাঠিয়ে ধরিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর কিছুদিন প্রকাশ্যে খেলা বন্ধ ছিল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চারঘাট উপজেলা সদরের এক কলেজশিক্ষক বললেন, তাঁর ছেলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ত। স্মার্টফোনে আসক্ত হয়ে সে এখন পাঠ্যবই পড়া বন্ধ করে দিয়েছে। ঘোষণা দিয়েছে, বিদ্যালয় খুললেও সে আর বিদ্যালয়ে যাবে না। তার নাকি সনদের প্রয়োজন নেই।