গিজগিজ করছে পর্যটক, সংকটে ছেঁড়াদিয়া

প্রতিদিন এমন কয়েক শ পর্যটক ঘুরে বেড়ান প্রতিবেশ সংকটাপন্ন দ্বীপ ছেঁড়াদিয়ায়। এঁদের বেশির ভাগের মুখেই মাস্ক নেই
ছবি: প্রথম আলো

সেন্ট মার্টিন দ্বীপটির আয়তন আট বর্গকিলোমিটার। বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত দ্বীপটির দক্ষিণে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন আরেকটি দ্বীপ ছেঁড়াদিয়া। ছেঁড়াদিয়ায় পর্যটকের সমাগম নিষিদ্ধ। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে প্রতিদিন কয়েক শ পর্যটক সেখানে ঘুরতে যাচ্ছেন।

৩০০ থেকে ৫০০ বর্গমিটার আয়তনের এই ছেঁড়াদিয়ায় এখনো লোকবসতি শুরু হয়নি। জনশূন্য এই দ্বীপে ভাটার সময় সেন্ট মার্টিনের দক্ষিণ অংশ থেকে হেঁটে যাওয়া যায়। তবে জোয়ারের সময় পাথরস্তূপ ডুবে গেলে নৌযানের প্রয়োজন পড়ে। সম্প্রতি সরেজমিনে ছোট্ট দ্বীপটিতে পর্যটকে ‘গিজগিজ’ করতে দেখা গেল। বেশির ভাগের মুখেই মাস্ক নেই। নেই স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই।

২২ জানুয়ারি বেলা ১১টায় ছেঁড়াদিয়ায় গিয়ে দেখা গেছে, পর্যটকেরা দ্বীপের এদিক-সেদিক ঘুরছেন। দ্বীপের চারপাশের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাথরস্তূপে দাঁড়িয়ে পর্যটকেরা ছবি তুলছেন, কেউ কেউ মুঠোফোনে ধারণ করছেন ভিডিও চিত্র। দ্বীপের যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্লাস্টিকের বোতল, টিনের কৌটা, চিপসের প্যাকেট, পলিথিনসহ নানা আবর্জনা। জোয়ারের পানিতে এসব আবর্জনা সমুদ্রে ভেসে যাচ্ছে। দ্বীপের বালুচরে অস্থায়ীভাবে নির্মিত কয়েকটি দোকানপাটে বিক্রি হচ্ছে ডাব, তরমুজ, চা-বিস্কুট, ভাজা মাছসহ নানা পণ্য।

সেন্ট মার্টিন জেটিঘাট থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে (দক্ষিণে) ‘দিয়ারমাথা’ নামক স্থানে চলাচল করছে ৫৩টি দ্রুতগতির স্পিডবোট ও ১৫টির বেশি ট্রলার। প্রতিটা স্পিডবোটে ১০ জন করে পর্যটক ওঠেন, ভাড়া আসা–যাওয়া ৩০০ টাকা। প্রতিটি ট্রলারে বোঝাই হন ৩০ থেকে ৮০ জন। দিয়ারমাথায় নৌযানগুলো পৌঁছে পর্যটকদের তুলে দেয় ডিঙিনৌকায়। এরপর ডিঙিগুলো পর্যটকদের কূলে তুলে দেয়। পানির নিচে পাথরস্তূপ থাকে বলে স্পিডবোট ও ট্রলারগুলো সরাসরি কূলে ভিড়তে পারে না। ডিঙিতে কূলে ওঠা–নামার ক্ষেত্রে জনপ্রতি ২০ টাকা করে পরিশোধ করতে হয়। পর্যটক ওঠানো–নামানোর জন্য ডিঙি আছে ১৫-১৬টি। এরপর পর্যটকেরা দিয়ারমাথা থেকে হেঁটে দক্ষিণ দিকের ছেঁড়াদিয়া ঘুরে আসছেন। ছেঁড়াদিয়ার পরে বাংলাদেশের আর ভূখণ্ড নেই।

ছেঁড়াদিয়া ভ্রমণে এসে হতাশ কুমিল্লার আবু ছালেহ। তাঁরা সাতজন সকালে সেন্ট মার্টিন থেকে স্পিডবোটে ছেঁড়াদিয়া দেখতে আসেন। আবু ছালেহ (৪৫) বলেন, ‘তিন বছর আগে ছেঁড়াদিয়ায় এসে দ্বীপের চারপাশের পাথরস্তূপে প্রবাল, শৈবাল চোখে পড়েছিল, বালুচর ভরপুর ছিল শামুক-ঝিনুকে। স্বচ্ছ নীল জলে নানা প্রজাতির রঙিন মাছের দৌড়ঝাঁপ দেখেছি। এখন তার কিছুই নেই। হাজারো মানুষে গিজগিজ করছে।’

ছেঁড়াদিয়ায় ঝুঁকি নিয়ে ডিঙিনৌকায় নামছেন পর্যটকেরা। ডুবে গেলে পানির নিচে পাথরের স্তূপে আটকা পড়ার শঙ্কা বেশি। লাইফ জ্যাকেটও থাকে না পর্যটকদের গায়ে

পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এই দ্বীপে ছিল প্রায় ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ১৮৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ১৫৭ প্রজাতির গুপ্তজীবী উদ্ভিদ, ২৪০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, চার প্রজাতির উভচর, ১২০ প্রজাতির পাখি, ১৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে ছিল ৭ প্রজাতির কাঁকড়া, চার প্রজাতির লবস্টার, মাছের মধ্যে ভোল মাছ, রাঙাচকি, প্রজাপতি, রেডস্লিপার (লাল মাছ), ফ্লাইংফিশ ছিল অসংখ্য। দ্বীপটি তিন প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপের ডিম পাড়ার অন্যতম নিরাপদ স্থান ছিল। এখন অতিরিক্ত মানুষের কোলাহলে কচ্ছপের ডিম পাড়া হচ্ছে না। এক দশক ধরে পর্যটকদের পদচারণে ছেঁড়াদিয়ার অনেক কিছুই বিলুপ্ত হয়েছে।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, এখন দৈনিক ১০টি জাহাজ ও ৩০টির বেশি স্পিডবোট ও ট্রলারে সেন্ট মার্টিন ভ্রমণে যাচ্ছেন তিন হাজারের বেশি পর্যটক। সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্র ও শনিবার বাড়ে আরও দুই হাজার। এর মধ্যে প্রতিদিন অন্তত ১ হাজার পর্যটক ছেঁড়াদিয়া দ্বীপ ভ্রমণে যাচ্ছেন। কিন্তু সেখানে স্বাস্থ্যবিধি নিয়ন্ত্রণ এবং ময়লা–আবর্জনা পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার কেউ নেই।

পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের উপপরিচালক শেখ মো. নাজমুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের সেন্ট মার্টিন দ্বীপে পর্যটকের যাতায়াত সীমিতকরণসহ সেন্ট মার্টিনে পর্যটকের রাতযাপন কয়েক বছর বন্ধ রাখার উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। ইতিমধ্যে দ্বীপের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ–প্রতিবেশের সুরক্ষায় কয়েক দফা নীতিমালা ঘোষণা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। এর মধ্যে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন ছেঁড়াদিয়ায় পর্যটকের সমাগম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এখন সেখানে কেউ যাচ্ছে কি না দেখতে হবে।

পর্যটকবাহী জাহাজমালিকদের সংগঠন সি ক্রুজ অপারেটরস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (স্কুয়াব) সভাপতি তোফায়েল আহমদ বলেন, মাস্ক ছাড়া কোনো যাত্রীকে তাঁরা জাহাজে তোলেন না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পাশাপাশি প্রতিবেশ সংকটাপন্ন ছেঁড়াদিয়া ভ্রমণে বিধিনিষেধ জানিয়ে জাহাজে প্রচারণাও চালানো হয়। কিন্তু পর্যটকেরা দ্বীপে নামার পর সবকিছু ভুলে যান। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, মুখে মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে ইউনিয়ন পরিষদসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও তৎপর হতে হবে।