পুরো বাড়ি ঘিরে ঝোপঝাড়, লতাপাতা। ভেতরে সুনসান নীরবতা। গা ছমছম করা বাড়িটিকে মনে হবে ভুতুড়ে। ইট-সুরকি দিয়ে তৈরি এই লোহাবিহীন অট্টালিকা। বায়ান্ন একর জায়গা। তার ভেতর এই প্রাসাদ। এখানে আছে ছয়টি ঘর। বাইরে ও ভেতরে দেয়ালগুলোতে নানা রকম আগাছা ও লতা জন্মেছে। খসে পড়ছে ছাদ ও দেয়ালের পলেস্তারা। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার দক্ষিণ রাজানগর ইউনিয়নের রাজা ভুবন রাজবাড়ির কথা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম শহর থেকে কাপ্তাই সড়কপথে ৩৫ কিলোমিটার পাড়ি দিলেই দেখা যাবে এই প্রাসাদ। আর রাঙ্গুনিয়া উপজেলা সদর থেকে পারুয়া-রানীর হাট সড়কপথে সাত কিলোমিটার পথ পেরোতে হবে। পুরো পিচঢালা পথ হলেও রাজবাড়িতে ঢোকার আগে কিছু অংশে ইটের রাস্তা। প্রাসাদের সামনে ঝোপঝাড়। প্রাসাদটির কিছু দূরে কাঠের বেড়া ও টিনের ছাউনি দিয়ে বানানো ঘরে থাকেন চাকমা রাজার বংশধর রুমেল দেওয়ান। রুমেল দেওয়ান বলেন, রাজবাড়ির অনেক স্মৃতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
রুমেল দেওয়ানের বাবা প্রমতোষ দেওয়ান ২০ বছর ধরে রাজপ্রাসাদটি আঁকড়ে পড়ে ছিলেন। কয়েক বছর আগে মারা গেছেন।
রাজবাড়ির অদূরে রাজার হাটের পূর্বে রয়েছে বিশাল রাজার পুকুর। রাজা ভুবন এলাকা চাকমা রাজাদের সাবেক রাজধানী হিসেবে পরিচিত। রাজবাড়ির প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও বিভিন্ন স্থাপত্যকীর্তি নীরবে ক্ষয়ে যাচ্ছে।
ইতিহাস গবেষক জামাল উদ্দিনের পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস বই থেকে জানা যায়, ১৭৩৭ খ্রিষ্টাব্দে রাজা শেরমস্ত খাঁ রাঙ্গুনিয়ার পদুয়া ও কোদালা এলাকার কিছু পাহাড়ি ভূমি বন্দোবস্ত নিয়েছিলেন। রাজ্য পরিচালনার জন্য পদুয়ায় জমিদারবাড়ি গড়ে তোলা হয়। ১৭৩৭ থেকে ১৭৫৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত শেরমস্ত খাঁ রাজত্ব করেন। এরপর শুকদেব রায়, শের জব্বর খাঁ, শের দৌলত খাঁ, জান বক্স খাঁ। জান বক্স খাঁ রাজা থাকাকালীন ইংরেজদের বিরুদ্ধে পার্বত্যবাসী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। তখন ব্রিটিশ সেনা অভিযান চালিয়ে পদুয়ার জমিদারবাড়িটি গুঁড়িয়ে দেয়। জান বক্স খাঁ একপর্যায়ে সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তিনি চুক্তির শর্তানুযায়ী পাহাড়ি এলাকা ত্যাগ করে কর্ণফুলী নদীর উত্তর পারে বর্তমান দক্ষিণ রাজানগর ইউনিয়নে নতুন জমিদারবাড়িটি প্রতিষ্ঠা করেন।
রাজবাড়ির ইতিহাস সম্পর্কে জানতে চাইলে চাকমা রাজার বংশধর ৬৫ বছর বয়সী কর্ণরায় চৌধুরী বলেন, রাজা শুকদেবের মৃত্যুর পর জান বক্স খাঁ পদুয়া থেকে রাজানগরে চাকমা রাজ্যের রাজধানী স্থানান্তর করেন। পরে আবার রাজানগর থেকে রাঙামাটিতে রাজধানী স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ২০১০ সালের ১০ নভেম্বর বর্তমান চাকমা রাজপ্রাসাদটিও অগ্নিকাণ্ডে ধ্বংস হয়ে যায়। তাই রাঙ্গুনিয়ার রাজানগরের রাজবাড়িটি এখন কালের সাক্ষী।