সাখাওয়াৎ হোসেন (৫৫) প্রান্তিক কৃষক। বাড়ি গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার সমিতির বাজার গ্রামে। এবার এক বিঘা জমিতে বিআর-২৮ জাতের বোরো ধানের চাষ করেন। বীজ বপন থেকে ধান কাটা পর্যন্ত উৎপাদন খরচ হয়েছে প্রায় ১২ হাজার টাকা। ধান হয়েছে ২০ মণ। কিন্তু দাম তেমন নেই।
সাখাওয়াৎ বলেন, বর্তমান বাজারে প্রতি মণ ধান ৫৫০ টাকা। এ হিসাবে ২০ মণ ধানের দাম ১১ হাজার টাকা। এবার ধান আবাদ করে বিঘায় তাঁর লোকসান হয়েছে ১ হাজার টাকা। তাঁর ভাষায়, ‘বোরোর আবাদ করি নাব (লাভ) হওয়া দূরের কতা, এ্যাক বিগে জমিত ম্যালা ট্যাকা নোকসান দেওয়া নাগল।’
শুধু সাখাওয়াৎ নন, এবার বোরো ধান চাষ করে গাইবান্ধার বেশির ভাগ কৃষককে লোকসান দিতে হচ্ছে। হাটে ক্রেতা না থাকায় ধানের দাম কম বলে জানিয়েছেন চাষিরা। ফলে কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।
সমিতির বাজারেরই আরেক কৃষক কাশেম আলী বলেন, ‘এমনি আবাদের খরচ ওঠে না, তার ওপর ধানের দাম নাই। বাজারোত ধান নিয়্যা গেলে কাইয়ো দাম কয় না। বাদ্য হয়্যা ব্যাপারীর কাচে এক মোণ ধান সাড়ে পাঁচ শ ট্যাকা হিসাবে বেচপার নাগচি।’
একই উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামের মান্না মিয়া বললেন, ‘বোরো ধানের আবাদ করতে ট্যাকা বেশি নাগে। তাই এ্যাক বিগে জমি আদি (বর্গা) নিয়্যা ধান নাগাচিনো। ১২ হাজার ট্যাকা খরোচ করি ১৮ মোণ ধান পাচি। এক বিগে জমিত ২ হাজার ১০০ ট্যাকা নোকসান হচে। মালিকোক অর্দেক ধান দিলে কী থাকে?’
গত দুই দিনে কয়েকটি হাটবাজার ঘুরে দেখা যায়, ধানের ক্রেতা তেমন নেই।
গত বৃহস্পতিবার সদর উপজেলার কূপতলা বাজারে ধান বিক্রি করতে এসেছিলেন হাফেজ মিয়া। কূপতলা গ্রামেই তাঁর বাড়ি। তিনি জানান, জমি ছাড়া তাঁর আয়ের অন্য পথ নেই। ধারদেনা করে আবাদ করেন। আর ধান উঠলে বিক্রি করে দেনা পরিশোধ করেন। ধান কাটার শ্রমিক খরচও ধান বিক্রি করে দিতে হয়। তিনি বললেন, ‘বিকেল থেকে বাজারে অপেক্ষা করে ধান বিক্রি করতে পারিনি। বাধ্য হয়ে সন্ধ্যায় ব্যাপারীর কাছে এক মোণ ৫৫০ টাকায় বিক্রি করেছি।’
একই বাজারে আসা আবুল কালাম জানান, তিনি এক বিঘা জমিতে বিআর-২৮ জাতের ধানের চাষ করেছিলেন। ধানবীজ, সার, রোপণ, কর্তন, শ্রমিকসহ খরচ হয়েছে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার টাকা। কিন্তু ধান হয়েছে ১৯ মণ। বাজারে প্রতি মণ ধান ৫৫০ টাকা। সে হিসাবে এক বিঘা জমিতে তাঁর লোকসান হয়েছে ১ হাজার ৫০ টাকা।
কূপতলার পাশের দাড়িয়াপুর হাটেও একই চিত্র। গতকাল শুক্রবার ওই হাটে এসেছিলেন মালিবাড়ি গ্রামের শরিয়ত উল্যা। তিনি বললেন, ‘নোকসান হলেও হামারঘরে করব্যার কিচু নাই। বাপ-দাদার আমল থাকি আবাদ করব্যার নাগচি। অ্যাকনও পেশা ধরি আচি।’
জানতে চাইলে দাড়িয়াপুর গ্রামের ধান ব্যবসায়ী আলম মিয়া বলেন, ‘প্রতিবছর ধান কিনে চাল করে সরকারি গুদামে দিই। এবার সরকারিভাবে ধান কেনা এখনো শুরু হয়নি। এখন ধান কিনতে আগ্রহী নই।’
এ বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক এস এম ফেরদৌস বলেন, সরকারিভাবে বোরো ধান কেনা এখনো শুরু হয়নি। তাই কম দামে ধান বেচাকেনা হচ্ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এবার গাইবান্ধার সাতটি উপজেলায় ১ লাখ ২৭ হাজার ৭৪০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে চাষ হয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে। ফলনও ভালো হয়েছে। চাল আকারে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৩১ হাজার মেট্রিক টন। গত ২৫ এপ্রিল থেকে ধান-চাল কেনা শুরু করার কথা ছিল। কিন্তু গতকাল বিকেল পর্যন্ত কেনা শুরু হয়নি।
জানতে চাইলে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, শনিবার (আজ) ধানচাল কেনার বিষয়ে সভা ডাকা হয়েছে। কবে থেকে কেনা হবে, সে সিদ্ধান্ত হবে। ২৩ আগস্ট পর্যন্ত কেনা চলবে।