গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার দরদরিয়া গ্রামের দরিদ্র কৃষক মো. কফিল উদ্দিন। ছোট-বড় মিলিয়ে তাঁর গোয়ালঘরে সাতটি গরু। জমিতে হালচাষ, ধান মাড়াই বা দুধের ঘাটতি মেটানোর প্রধান ভরসা এসব গরু। গত ১০ এপ্রিল রাতে তাঁর চারটি গরু চুরি হয়ে যায়।
কফিল উদ্দিনের পাশেই তাঁর চাচাতো ভাই আতিকুল ও বিল্লাল হোসেনের বাড়ি। একই দিন তাঁদের গোয়ালঘর থেকেও চুরি হয় চারটি গরু। এক রাতে ওই আটটি গরু হারিয়ে খানিকটা নিঃস্ব হয়ে যায় ওই তিন পরিবার।
দরদরিয়া থেকে আনুমানিক তিন কিলোমিটার দূরে উপজেলার হাইলজোড় গ্রাম। এখানে হাইলজোড় পশ্চিমপাড়ায় পাওয়া গেল আরেক দরিদ্র কৃষক বাদল মিয়াকে। প্রায় ৪০ বছর ধরে মহিষের গাড়ি বেয়ে সংসার চালান তিনি। এর মাঝে গত ৬ এপ্রিল তাঁর দুটি মহিষ চুরি চায়। মহিষ দুটি হারিয়ে নিঃস্ব তিনি। থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেও মেলেনি মহিষের সন্ধান।
উপজেলার গ্রামে গ্রামে এখন গরু চুরির আতঙ্ক। শুধু দরদরিয়া গ্রামের কফিল বা হাইলজোড় গ্রামের বাদল মিয়ার গরু চুরির ঘটনাই নয়, প্রায় প্রতি রাতেই উপজেলার কোথাও না কোথাও ঘটছে এমন ঘটনা। এতে কৃষিকাজ বা আয়ের প্রধান অনুষঙ্গ হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন স্বল্প আয়ের অনেক কৃষক। আর পরপর এসব ঘটনা ঘটতে থাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে। তাই গরু হারানোর ভয়ে রাত জেগে গোয়ালঘর পাহারা দিচ্ছেন অনেক কৃষক।
গতকাল সোমবার ও আজ মঙ্গলবার এলাকায় ঘুরে কথা হয়, ভুক্তভোগী এসব কৃষকের সঙ্গে। এর মধ্যে কফিল উদ্দিন বলেন, কৃষিকাজ বা সংসারে দুধের ঘাটতি মেটাতে তার এই চারটি (২টি ষাঁড়, ১টি গাভি ও ১টি বাছুর) গরুই ছিল প্রধান ভরসা। কিন্তু হঠাৎই গরুগুলো চুরি যাওয়ায় বিপদে পড়েছেন তিনি। তাঁর মতে, গরুগুলোর বাজার মূল্য অন্তত দুই লাখ টাকা।
একই সুরে কথা বলছিলেন বাদল মিয়া। তিনি বলেন, সংসারের আয়, সন্তানের লেখাপড়ার খরচ বা কৃষিকাজ পুরোপুরি নির্ভর ছিল ওই দুটি মহিষের ওপর। হঠাৎই মহিষ দুটি চুরি হওয়ায় তিনি মহাবিপদে পড়েছেন। তিনি আরও বলেন, ‘মহিষ দুটি যেকোনো সময় বিক্রি করলে অন্তত সাড়ে তিন লাখ টাকা পাওয়া যেত। এ ঘটনার থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।’
এদিকে গরু চুরির এসব ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামের অন্যান্য কৃষকের মাঝে। গ্রামের বিভিন্ন মোড়ে চায়ের দোকান, আড্ডা বা জটলায় বারবার উঠে আসছে গরু চুরির এসব ঘটনা। এতে কেউ ঘটনার শিকার কৃষকের জন্য আফসোস করছেন, কেউবা নিজেদের গরু নিয়ে হচ্ছেন শঙ্কিত। এর মধ্যে কারও কারও কাছে শোনা যায় রাত জেগে গরু পাহারা দেওয়ার কথা।
গতকাল সোমবার ভুলেশ্বর গ্রামের মধ্যপাড়া এলাকায় একটি চায়ের দোকানে পাওয়া গেল এমনই এক কৃষক মো. শরিয়ত হোসেনকে। তাঁর ছোট-বড় চারটি গরু রয়েছে। এসব ঘটনার পর তিনি আতঙ্কিত হয়ে গোয়ালঘরের পাশেই বিছানা পেতেছেন। জমিতে সারা দিন কাজ শেষে রাত জেগে গরু পাহারা দেন। জানতে চাইলে শরিয়ত বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। অনেক কষ্টে গরু-ছাগল পালি। এর মধ্যে কোনো কারণে একটি গরু হারিয়ে গেলে বা চুরি হয়ে গেলে আমাদের পথে বসা ছাড়া উপায় থাকব না। তাই বাধ্য হয়েই গোয়ালঘরের পাশে বিছানা পেতেছি, রাত জেগে গরু পাহারা দিই।’
তবে গ্রামবাসীর দাবি, পরপর গরু চুরির এমন ঘটনাগুলো ভীতিকর। তাঁদের মতে, এলাকার স্থানীয় কোনো ব্যাক্তি বা অপরাধী চক্রের যোগসাজশেই এসব চুরি হয়। সে ক্ষেত্রে পুলিশ বা প্রশাসনের দিক থেকে যথাযথ তৎপরতা দেখালে বারবার এমন ঘটত না বলে দাবি তাঁদের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একটি স্কুলের শিক্ষক বলেন, ‘প্রায় প্রতিটি ঘটনায়ই কৃষকেরা সংশ্লিষ্ট থানায় ছুটে যান, অভিযোগ করেন। কিন্তু কোথাও চোর ধরার খবর বা হারানো গরু উদ্ধারের খবর পাওয়া যায় না।’
এদিকে গরু চুরির বিষয়ে প্রায়ই অভিযোগ পাওয়ার কথা শিকার করেন কাপাসিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আলম চাঁদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিটি ঘটনায়ই আমরা মামলা নিচ্ছি। ইতিমধ্যে অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে ৮–১০ জন চোরকেও ধরা হয়েছে। এর বাইরে ইউনিয়নের মেম্বার, চেয়ারম্যান বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে বসে চোর নির্মূলে কাজ করা হচ্ছে। চোরদের ধরতে ইতিমধ্যে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে পাহারা বা চেকপোস্ট জোরদার করা হয়েছে।’