পদ্মার ভাঙনে বিলীন হচ্ছে ফসলি জমি, খেত ও বাগান। গত মঙ্গলবার বিকেলে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার সাহেবনগর গ্রামে
পদ্মার ভাঙনে বিলীন হচ্ছে ফসলি জমি, খেত ও বাগান। গত মঙ্গলবার বিকেলে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার সাহেবনগর গ্রামে

খেত বিলীন, সড়ক হুমকিতে

বহলবাড়িয়া, তালবাড়িয়া ও পশ্চিম বাহিরচর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে ভাঙন দেখা দিয়েছে। দিশাহারা হয়ে পড়েছেন কয়েক শ কৃষক।

তিন ফসলি জমিতে গম, মসুর, শর্ষেসহ নানা ধরনের সবজির চাষ হচ্ছে, আছে কলার আবাদও। কেউ করেছেন পেয়ারা ও লেবুর বাগান। সবুজে ঘেরা আবাদি জমির মাঠ বিলীন হয়ে যাচ্ছে পদ্মার ভাঙনে।

এ চিত্র কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার বহলবাড়িয়া, তালবাড়িয়া ও পশ্চিম বাহিরচর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের। দিশাহারা হয়ে পড়েছেন সেখানকার কয়েক শ কৃষক। পাশাপাশি ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে কুষ্টিয়া-ঈশ্বরদী মহাসড়ক ও জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের কয়েকটি খুঁটি।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র জানায়, বিভিন্ন সময়ে তালবাড়িয়া ও বহলবাড়িয়া ইউনিয়নের প্রায় ৯ কিলোমিটার এলাকা পদ্মার ভাঙনের মুখে পড়েছে। ২০১৬ সালের দিকে সেখানে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের জন্য ৬০০ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়। সর্বশেষ সেটি ৯৯০ কোটি টাকার প্রকল্পে দাঁড়ায়। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) নির্বাহী কমিটিতে প্রকল্পটি পাস হয়নি, যে কারণে বাঁধ নির্মাণ করা যাচ্ছে না।

গত মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে চারটায় সাহেবনগর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, রহিম বিশ্বাস চাদর মুড়ি দিয়ে খেতের ওপর দাঁড়িয়ে পদ্মার দিকে চেয়ে আছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার পিরাই (প্রায়) ৮০ বিঘা সম্পদ ছিল। কলার আবাদ ছিল ৯ বিঘায়। সব পানিতে চলি গেছে। এখন মাথা গোঁজার জায়গাটুকুও থাকবে না। মাঠ ভাঙি বাড়ির দিকে যাচ্ছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে পরিবার।’

ভাঙনকবলিত এলাকায় রহিম বিশ্বাসের মতো গ্রামের মানুষ ভিড় করছেন। তাকিয়ে দেখা ছাড়া তাঁদের কিছুই করার নেই।

মাঠের পর মাঠজুড়ে সবুজ খেত। বিঘার পর বিঘা কলার আবাদ। কারও খেতে গম রয়েছে, কেউ বুনেছেন পেঁয়াজ। কাঁচা গম কেটে নিয়ে বাড়িতে ফিরছিলেন কামরুজ্জামান। তিনি জানালেন, তাঁর ছয় বিঘা জমির মধ্যে গত এক মাসে পাঁচ বিঘা পদ্মার ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। কাঁচা গম যেটুকু আছে, সেটুকু কেটে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন গরুকে খাওয়ানোর জন্য।

কৃষক আরাফাত হোসেন বলেন, ১৮ বিঘা জমিতে তাঁর কলাবাগান ছিল। ১৬ বিঘা নদীতে চলে গেছে। গম ছিল ৬ বিঘা, আছে মাত্র ১০ কাঠা। মসুরের খেতের অর্ধেক বিলীন হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত ভাঙন প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

কৃষক সুজা উদ্দীন নদীর পাড়ে চুপচাপ বসে আছেন। দুই মাস আগেও বসতভিটা থেকে ৫০০ মিটার দূরে ছিল নদী। ভাঙতে ভাঙতে বাড়িঘরের কাছাকাছি চলে আসছে। আর এক মাস এমন ভাঙন হলে বাড়িঘরসহ মহাসড়কও বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

ভাঙনের কারণ

ভাঙনের কারণ জানতে পাউবোর কর্মকর্তা ও স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের সবার একই ধরনের মন্তব্য। জানালেন, প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে পদ্মার ওপারে ঈশ্বরদী এলাকার রূপপুরে পদ্মা নদীর ভেতরে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। সেই বাঁধে পানি বাধা পাওয়ায় বিপরীত দিকের বহলবাড়িয়া ও তালবাড়িয়া এলাকার দিকে নদীর গতিপথ সরে আসছে। এতেই পানি এসে ধাক্কা দিয়ে মাটি ভেঙে দিচ্ছে। এ বছর ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। যেভাবে পদ্মায় ভাঙন দেখা দিয়েছে, তাতে দ্রুত প্রতিরোধ করা না গেলে কুষ্টিয়া-ঈশ্বরদী মহাসড়ক নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের ৩২টি জেলার মধ্যে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।

তালবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল হান্নান বলেন, ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। এখনই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়ন না করা গেলে মহাসড়কসহ এলাকার সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নদীতে চলে যাবে।

কুষ্টিয়া পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আফছার উদ্দীন বলেন, নদীর গতিপথ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। রূপপুরে ৩০০ মিটার নদীশাসনের কারণে নদীর গতিপথ বদলে মিরপুরের তালবাড়িয়া ও বহলবাড়িয়ার দিকে চলে আসছে।

হুমকিতে বিদ্যুতের টাওয়ার

সাহেবনগর মাঠের মধ্য দিয়ে গেছে বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন। এর চারটি টাওয়ার পড়েছে মাঠের মধ্যে, যা ভাঙনকবলিত এলাকা থেকে মাত্র দেড় শ মিটার দূরে। গত শুক্রবার জাতীয় গ্রিডের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। কুষ্টিয়ার বটতৈল জাতীয় গ্রিডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সাহেবনগর এলাকায় চারটি টাওয়ার হুমকিতে আছে। এ লাইন দিয়ে রাজবাড়ীতে বিদ্যুৎ সঞ্চালন করা হয়। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে জানানো হয়েছে।

কুষ্টিয়া পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আফছার উদ্দীন বলেন, ভাঙনকবলিত ৯ কিলোমিটারের অবস্থা খুবই ভয়াবহ। কুষ্টিয়া-ঈশ্বরদী জাতীয় মহাসড়কও হুমকিতে পড়েছে। একনেকে প্রকল্প পাস না হলে স্থায়ীভাবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। ভাঙন প্রতিরোধে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে বালুবোঝাই জিও ব্যাগ ফেলার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।