খাইরুলের দোকানে সততার চর্চা

গাজীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খাইরুলের দোকানে কেনাকাটা করছে এক শিশু। প্রথম আলো
গাজীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খাইরুলের দোকানে কেনাকাটা করছে এক শিশু।  প্রথম আলো

রোববার সকাল নয়টা। শুভা আক্তার নামের এক শিশুশিক্ষার্থী ৪০ বছর বয়সী এক ব্যক্তিকে হাত ধরে বিদ্যালয়ের সীমানার ভেতরে নিয়ে যাচ্ছিল। ভেতরে বটগাছের পাশে ওই ব্যক্তির ছোট্ট টংদোকান। দোকানে গিয়ে লোকটির একটা হাতে তালা ধরিয়ে দিল শিশুটি। তালা খোলা হলো। এবার দোকান গোছগাছে সহযোগিতা করতে এল আরেক শিশু। বেচাকেনা শুরু হলো। শিশুরা এসে নিজ দায়িত্বে পণ্য নিয়ে প্রকৃত মূল্য পরিশোধ করে যাচ্ছে। দোকানের পাশে দাঁড়ালে কানে আসে, ‘কাকা, খাতা নিলাম, ১৫ টাকা’; ‘খাইরুল কাকা, দুইটা চকলেট নিলাম, ৪ টাকা।’

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার গাজীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণের ওই দোকান খাইরুল ইসলাম নামের এক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর। আর হাত ধরে নিয়ে যাওয়া ওই শিক্ষার্থী দোকানের একজন ক্রেতা ও ওই স্কুলের শিক্ষার্থী। খাইরুল দোকান চালাচ্ছেন আট বছর ধরে। বিদ্যালয়ে বটগাছের নিচের দোকানটি চলছে শিক্ষার্থীদের সততার ওপর ভিত্তি করে। তাঁর ক্রেতা মূলত ওই স্কুলের শিক্ষার্থীরা। আট বছর ধরেই তাঁর সব লেনদেনের কাজটি করছে খুদে শিক্ষার্থীরা। ক্রেতা হিসেবে ওই শিক্ষার্থীরা দোকান থেকে যা-ই কেনে না কেন, তার মূল্য নির্দিষ্ট বাক্সে রেখে দোকানিকে বলে যায় কত টাকা রেখে যাওয়া হলো। এই বিশ্বাস আর অল্প কিছু পুঁজিতেই খাইরুলের দোকান চলে। এই দোকানের আয় থেকে খাইরুলের সংসার চলে।

কথা হয় খাইরুলের সঙ্গে। দোকানের হিসাব-নিকাশে কোনো গরমিল হয়নি এই আট বছরে। ‌বাড়ি থেকে দোকানে যাওয়া ও দোকান বন্ধ করে বাড়িতে ফেরার সময় সহযোগিতা করছে শিক্ষার্থীরা, জানান তিনি। তিনি বলেন, বেশির ভাগ শিশু তাঁকে ‘আঙ্কেল’ বলে ডাকে। অনেকে ‘খাইরুল ভাই’ও বলে। তাঁর নিজের দুই সন্তান। একজন মাহফুজা আক্তার। সে গাজীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। অন্যজন মাহিম আহমেদ। সে-ও একই স্কুলের প্রথম শ্রেণিতে পড়ে।

খাইরুল জানান, পাঁচ বছর বয়সে তাঁর মা মারা যান। সাত বছর বয়সে তাঁর বাবাও মারা যান। এরপর পুরোপুরি অসহায় হয়ে পড়া খাইরুল অনেক কষ্টে নিজেকে তৈরি করেন। একসময় কাজ নেন স্থানীয় কাজী গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠানে। সেখানে দীর্ঘদিন চাকরি করেন। কিন্তু আট বছর আগে হঠাৎ তাঁর চোখে গ্লুকোমা ধরা পড়ে। খুব দ্রুতই তিনি পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যান। এরপর তিনি ঠিক করেন, বাড়ির পাশের বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে দোকান দেবেন। তাঁর ইচ্ছার কথা জানালে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়ে দোকান স্থাপনের অনুমতি দেয়। তিনি অন্ধত্বকে ভুলে গিয়ে দোকান শুরু করেন। শুরু থেকেই তাঁর ক্রেতা হিসেবে ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাঁকে সহযোগিতা করতে থাকে। দোকানের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থী ও তাঁর মধ্যে নির্মোহ সততার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিনি বলেন, শুরুতে তাঁর স্ত্রী তাঁকে দোকানে নিয়ে যেতেন। দোকানে কিছুক্ষণ অবস্থান করে পুরোপুরি গুছিয়ে দিয়ে যেতেন স্ত্রী। কিন্তু দ্রুতই তাঁকে দোকানে নিয়ে আসার কাজটিতে সহযোগিতার হাত বাড়ায় শিক্ষার্থীরা।

দোকানের সামনে কিছুক্ষণ অবস্থান করে দেখা যায়, একের পর এক শিক্ষার্থী দোকানে গিয়ে পণ্য চেয়ে নিচ্ছে। কোনো শিক্ষার্থী কলম চাইলে খাইরুল হাত উঁচু করেন। শিক্ষার্থীরা নির্দেশনা দেয়, ‘একটু বামে, একটু ওপরে।’ সেই নির্দেশনা পেয়ে খাইরুল ঠিক ঠিক পণ্যটি খুঁজে পান। তুলে দেন ক্রেতা শিক্ষার্থীর কাছে। এ ছাড়া বেশির ভাগ সময় শিক্ষার্থীরা নিজেরাই পণ্য নিয়ে টাকা বাক্সে রেখে যায়।

সিনহা জাফরিন তানহা নামের চতুর্থ শ্রেণির এক শিক্ষার্থী বলে, ‘আঙ্কেলের দোকানে যা-ই কিনি, ঠিক ঠিক টাকা পরিশোধ করি। আঙ্কেল অনেক ভালো মানুষ। তাঁকে কেউ ঠকায় না।’ জুই আক্তার নামের আরেক শিক্ষার্থী বলে, ‘আঙ্কেল চোখে দেখতে পান না। কিন্তু তিনি হাত দিয়ে দোকানের জিনিস ধরতে পারেন। যদি তাঁর অসুবিধা হয়, তখন আমরা তাঁকে সহযোগিতা করি।’

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহিনুর ইসলাম বলেন, ‘খাইরুলের জীবন থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। মানুষ কীভাবে নিজের সীমাবদ্ধতাকে ছাপিয়ে জীবন চালিয়ে নেয়, সংসারের চাকা ঘোরায়, তা দেখিয়েছেন খায়রুল। আমরা তাঁকে এখানে দোকান চালানোর অনুমতি দেওয়ার মাধ্যমে একটি সামাজিক দায়িত্ব পালন করছি বলে মনে করি।’