সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী জোবায়দুল ইসলাম। বাবা মমিনুল ইসলাম। পেশায় দিনমজুর। কয়েক বছর আগে বাবা তাদের ফেলে রেখে চলে যান। মা জহুরা খাতুন কোনো উপায় না পেয়ে দুই সন্তানকে নিয়ে নানির বাড়িতে ওঠেন। নানা মারা গেছেন অনেক দিন আগে। অভাবের সংসার, মা বাধ্য হয়ে গাজীপুরে গার্মেন্টসে কাজ করতে যান। জোবায়দুল নানির কাছে মানুষ হচ্ছে। মা কাজ করে যা আয় করেন, তাই দিয়ে সংসার চলে। ঈদ উপহারের বস্তা মাটিতে রেখে মাথা নিচু করে কিছু একটা করছিল জোবায়দুল। কাছে গিয়ে মাথায় হাত রেখে কথা বলতেই চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে কয়েক ফোঁটা পানি।
বেলা ১১টায় কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ঘোগাদহ ইউনিয়নে প্রথম আলো চর আলোর পাঠশালা মাঠে শিক্ষার্থীদের মধ্যে করোনাকালে প্রথম আলো ট্রাস্টের দেওয়া ঈদ উপহারসামগ্রী বিতরণের সময়কার ঘটনা এটি। জোবায়দুল চোখ মুছে প্রথম আলোকে বলে, ‘আমি নানির কাছে থাকি। খুব কষ্ট করে চলি। মা কাম করি যে ট্যাকা দেয়, তাকে দিয়া চলি। প্যাট ভরি খাওয়া হয় না। এ্যাগলা পায়া উপকার হইলো। কয়েক দিন প্যাট ভরে খাবার পামো।’
প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে ও সামিট গ্রুপের সহযোগিতায় এসব উপহারসামগ্রী বিতরণ করা হয়। উপহারসামগ্রীর মধ্যে ভাতের চাল, ডাল, পোলাওয়ের চাল, চিনি, সয়াবিন তেল ও সেমাইয়ের প্যাকেট ছিল। কুড়িগ্রাম প্রথম আলো চর আলোর পাঠশালার ২৬৭ জন শিক্ষার্থীর হাতে এসব উপহারসামগ্রী তুলে দেওয়া হয়।
প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী রাকিব হোসেন। বাবা সাইফুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে আসে উপহারসামগ্রী নিতে। যাওয়ার সময় সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘এটা সেমাই খাওয়া ঈদ। হামরা চরের মানুষ সেমাই, পোলাও কোটে পাই। গরিব মানুষ ভাতে পায় না, আরও পোলাও! সেমাই! তোমার দেওয়া সেমাই, পোলাওয়ের চাউল পায়া এবার খাবার পামো।’
অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী পারভিন আক্তারের বাড়ি চর কাফনা। বাবা কৃষিশ্রমিক বানিজ উদ্দিন ঢাকায় কাজ করতে গেছেন। বাড়িতে রয়েছেন মা মালেকা বেগমসহ আরও দুই ভাইবোন। করোনাকালে দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় বাবা বাড়ি আসতে পারছেন না। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন মালেকা বেগম। মেয়ের সঙ্গে ঈদ উপহার হাতে নিয়ে তিনি বলেন, ‘খুব কষ্টে চলবার নাগছি। ঈদের সময় কী করমো বুঝবার পারছিলাম না। তোমারগুলার দেওয়া উপহারগুলা পায়া উপকার হইলো। কয়দিন ছাওয়াটাক ধরি প্যাট ভরি খাবার পামো। ইয়ার মধ্যে ওমরা (স্বামী) চলি আসবে।’
সুমি আখতারের বাবা মারা গেছেন অনেক দিন। মাসহ তার ঠাঁই হয়েছে বড় ভাইয়ের সংসারে। চেহারায় ফুটে আছে দারিদ্র্যের ছাপ। বড় ভাই একাব্বর দুধকুমার নদে মাছ ধরে কোনোরকম সংসার চালান। উপহারসামগ্রী হাতে নিয়ে মলিন মুখে সুমি বলে, ‘উপহার দেখিয়া ভাইয়ো খুশি হইবে।’
প্রথম আলো চর আলোর পাঠশালা মাঠে উপহারসামগ্রী তুলে দেওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন চরের বাসিন্দা আব্দুস সোবহান ব্যাপারী, ফজলার রহমান, সহিদুল ইসলাম, মো. সাইফুদ্দিন, তবিজন বিবি ও লায়লা বেগম, প্রথম আলো চর আলোর পাঠশালার প্রধান শিক্ষক আতাউর রহমান, সহকারী প্রধান শিক্ষক আব্দুল কাদের, আবৃত্তিশিল্পী মামুন উর রশিদ, শৌখিন আলোকচিত্রী সফিকুল ইসলাম ও কুড়িগ্রাম প্রথম আলো প্রতিনিধি সফি খান।
আব্দুস সোবহান বলেন, ‘করোনাকালে চরাঞ্চলের মানুষের হাতে কোনো কাজ নেই। বেকার জীবন যাপন করছেন। পরিবার-পরিজন নিয়া কষ্টে থাকেন। ধারদেনা করে চলছেন। প্রথম আলো ট্রাস্টের দেওয়া ঈদ উপহারগুলো অনেক কাজে লাগবে। মানুষ গোশত, পোলাও, সেমাই খেতে পারবেন। এ জন্য প্রথম আলোকে ধন্যবাদ জানাই। তারা সারা বছর চরাঞ্চলের মানুষের পাশে থাকে। নানা সহায়তা করে যাচ্ছে। স্কুলটা না হলে আমাদের চরের বাচ্চারা কামলা দিয়া খেত। স্কুলের কারণে বদলে যাচ্ছে প্রথম আলো চর।’