কৃষিশ্রমিক লিয়াকত আলী সাত সদস্যের পরিবার নিয়ে আগে ছাপরাঘর থাকতেন। এখন আর দুশ্চিন্তা নেই। তাঁরা এখন পাকা বাড়িতে থাকছেন
কৃষিশ্রমিক লিয়াকত আলী সাত সদস্যের পরিবার নিয়ে আগে ছাপরাঘর থাকতেন। এখন আর দুশ্চিন্তা নেই। তাঁরা এখন পাকা বাড়িতে থাকছেন

কেটেছে আতঙ্ক, ফিরেছে স্বস্তি

শ্রবণপ্রতিবন্ধী বৃদ্ধ মা লাকজানন্নেছা (৭০), বাক্ ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী তিন সন্তান রিপা মণি (১৬), লিটন মিয়া (১২), তরিকুল মিয়াসহ (৬) সাত সদস্যের পরিবার নিয়ে অন্যের জায়গায় একটি ছাপরাঘরে বাস করতেন নেত্রকোনার খালিয়াজুরির জাহেরপুর গ্রামের কৃষিশ্রমিক লিয়াকত আলী (৫০)।

হাওরের প্রচণ্ড বাতাস, ঢেউ বা আফালের ভাঙনে গত তিন দশকে অন্তত পাঁচবার স্থানও পরিবর্তন করতে হয়েছে লিয়াকতকে। বর্ষাকাল শুরু হলেই বছরের প্রায় অর্ধেক সময় কাটাতে হতো আতঙ্কের মধ্যে। এখন আর সেই দুশ্চিন্তা নেই। তিনি পরিবার নিয়ে পাকা বাড়িতে বসবাস করছেন।

প্রতিবেশী বিধবা আয়েশা আক্তার (৬৫) চলাফেরায় অক্ষম বাক্ ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মেয়ে খুদেজাসহ (১৬) পাঁচ সন্তান নিয়ে অন্যের জমিতে ছোট্ট ছাপরায় জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন। গত এক যুগে তাঁর স্থান পরিবর্তন করেছেন তিনবার। বড় দুই ছেলে ও এক মেয়ে বিয়ের পর তাঁর খোঁজ রাখেন না। অন্যের বাড়িতে কাজকর্ম করে প্রতিবন্ধী মেয়েটি ও ছোট ছেলে আবু তাহেরকে (১২) নিয়ে কোনোরকমে জীবন চালান তিনি। পাকা বাড়ি তাঁর কাছে কল্পনার অতীত ছিল। তিনিও পাকা একটি বাড়ি পেয়েছেন।
গত সোমবার উপজেলা প্রশাসন তাঁর বাড়িটি বুঝিয়ে দেয়। প্রতিবন্ধী সন্তান নিয়ে শেষ বয়সে এ আশ্রয় পেয়ে তিনি অনেকটাই স্বস্তিতে রয়েছেন। তিনি বলেন, ‘অহন থাইক্কা শান্তিতে ঘুমাইতে পারি। কোন রইদ বৃষ্টি আয়ে না।’ ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা ব্যয়ে বাড়িটিতে রয়েছে দুটি করে শোবার ঘর, একটি করে রান্নাঘর, শৌচাগার ও ঘরের সামনে একটি বারান্দা।

শুধু লিয়াকত বা আয়েশাই নন, খালিয়াজুরি উপজেলাতে এমন পাকা বাড়ি পেয়েছেন অন্তত ৪৪৩টি পরিবার। আরও ৪০০টি পরিবারের জন্য দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ চলছে। গত ‍বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাওরাঞ্চলের ওই উপজেলার মুজিবনগর, মুমিননগর, জাহেরপুর, শ্যামপুর, যাদবপুরসহ সাতটি গ্রামে ঘুরে দেখা গেছে, ছোট গ্রামগুলোতে কোথাও থেকে থেকে আবার কোথাও সারিবদ্ধভাবে রঙিন এসব ঘর শোভা পাচ্ছে। চারদিকে বিস্তীর্ণ মাঠে সোনালি ধান বাতাসে দোল খাচ্ছে।

স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, আর মাসখানেকের মধ্যে যখন বর্ষা শুরু হবে, তখন প্রায় সাত মাস এসব বাড়ির চারদিকে শুধু পানি আর ঢেউয়ের খেলা হবে। উপজেলা সদর ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মুজিবনগর গ্রামটির ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। ১৯৯৬ সালে ওই ইউপির চেয়ারম্যান ছানোয়ারুজ্জামান তালুকদার একটি প্রকল্প তৈরি করে হাওরের মাঝে প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ সরকারি জায়গায় গ্রামটি স্থাপন করেন। পরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে গ্রামের নামকরণ করেন তিনি। বর্তমানে গ্রামটিতে প্রায় দেড় হাজার মানুষ বসবাস করছে। ওই গ্রামে ৭৩টি পরিবারের মধ্যে পাকা ঘর হস্তান্তর করেছে প্রশাসন।

এক সপ্তাহ আগে নতুন ঘরে উঠেছেন শারীরিক প্রতিবন্ধী বিধবা আয়েশা। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী আব্বাস আলী ভুঁইয়া ১০ বছর আগে মইরা গেছে। এক ছেলে ও দুই মেয়ে, তারারে বিয়া দেওনের পর কেউ দেহে না আমারে। আমি প্রতিবন্ধী ভাতা ও মাইনসের সাহায্য দিয়া চলি। আমার কোনো ঘর আছিল না। মাইনসের একটা ভাঙা ঘরে থাকতাম। বাইষা মাসে ঘরের চালের ছিদ্রি দিয়া পানিতে সব ভিজত। আমি ঘরে ছাতি টাঙ্গাইয়া থাকতাম। এমন মাগনামাগনি পাক্কা বাড়ির মালিক হইয়াম। এইডা জীবনেও ভাবতাম পারছিলাম না।’

নেত্রকোনার খালিয়াজুরির জাহেরপুর গ্রামের ১১১ হতদরিদ্র ভূমিহীন পরিবার পেয়েছে পাকা ঘর

ওই গ্রামের দিনমজুর নজরুল ইসলামের মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া রুনা আক্তার বলে, ‘আমরা তিন বোন, দুই ভাইসহ বাবা–মা খুব কষ্ট কইরা মাটির ভাঙা ঘরে ঝড়বৃষ্টির মধ্যে আতঙ্কে থাকতাম। দুই ভাই ছোট্ট, বোনরা ইস্কুলে পড়ি। ইউএনও স্যার আমরার কষ্ট দেইখ্খা সরকারি এই পাক্কা ঘরটি দিছেন। ঘরে কারেন্টের বাতি জ্বলে। আমরা কখনো পাক্কা ঘরে থাকার চিন্তা করিনি। এখন আমরার খুবই আনন্দ লাগে। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ। তিনি আমাদের মতো গরিবদের কথা মনে রাখেন।’

স্থানীয় বাসিন্দা ও উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, মুজিব শতবর্ষে দেশের কোনো মানুষ গৃহহীন থাকবে না—প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন নির্দেশনা বাস্তবায়নে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য বাসস্থান নির্মাণ প্রকল্পের কাজ চলছে। জেলার ১০টি উপজেলায় প্রথম পর্যায়ে ৯৬০টি ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর মধ্যে খালিয়াজুরিতে ৪৪৩টি ঘর রয়েছে। সব ঘরের কাজ শেষ হয়ে গেছে। এখন সুবিধাভোগীদের হস্তান্তর করা হচ্ছে।

খালিয়াজুরি উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সুমন চক্রবর্তী বলেন, ‘প্রায় ১ লাখ ১৬ হাজারের জনসংখ্যার এই উপজেলায় অধিকাংশ মানুষ হতদরিদ্র। তাঁদের জায়গাজমি ঘরবাড়ি নেই। কৃষিশ্রমিক ও মাছ ধরার ওপর নির্ভরশীল। বছরের অর্ধেক সময় সারা উপজেলায় থইথই পানি থাকে। হাওরের ৪৪৩টি পরিবার পাকা ঘর পাওয়ায় তাদের আতঙ্ক অবসান হয়ে স্বস্তির জীবন লাভ করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিনা মূল্যে হতদরিদ্র ভূমিহীনদের গৃহনির্মাণ প্রকল্পটি এলাকায় সাড়া ফেলেছে। এতে সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হচ্ছে।

ইউএনও এ এইচ এম আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘হাওরে রাস্তাঘাটের সমস্যায় নির্মাণসামগ্রী পরিবহনে কষ্ট হলেও কাজের গুণগত মান ঠিক রেখে ৪৪৩টি ঘর তৈরিতে আমি সবার সহযোগিতা পেয়েছি। ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনার মো. কামরুল হাসান ও জেলা প্রশাসক কাজী মো. আবদুর রহমান স্যারগণ নির্দেশনা ও পরামর্শ প্রকল্প বাস্তবায়নে সাহস জুগিয়েছেন। যাঁরা ঘর ও জমি পেয়েছেন, তাঁদের যে আনন্দ, তা আমাকে অনুপ্রাণিত করে।’

তিনি জানান, এ ছাড়া উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মুজিব শতবর্ষে দেড় হাজার ভূমিহীন পরিবারকে ৪০ থেকে ৬০ শতক করে খাস কৃষিজমি বন্দোবস্ত দেওয়ার কাজ চলছে। এর মধ্যে এক হাজার পরিবারকে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে।