কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গত দুইবারের মেয়র মো. মনিরুল হকের (সাক্কু) পরাজয়ের কারণ নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ ও আলোচনা। বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকা মনিরুল দলের সমর্থন না পেয়ে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী হন। নির্বাচনের মাঠে সরকারদলীয় নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আরফানুল হকের পাশাপাশি তাঁকে লড়তে হয়েছে নিজদলীয় রাজনৈতিক আদর্শের নেতা মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিনের সঙ্গেও। নিজাম স্বেচ্ছাসেবক দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁরা দুজনই নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন।
বিএনপির ভোট দুই ভাগ হয়ে যাওয়ায় মূলত মনিরুলের পরাজয় হয়। মনিরুল যে ভোট পেয়েছেন, তার অধিকাংশ সাধারণ ভোটারের ভোট। আর নিজাম উদ্দিনের বাক্সে গেছে বিএনপির অধিকাংশ ভোট।শাহ মো. আলমগীর খান, সভাপতি, সুজন
কুমিল্লার সাধারণ ভোটার, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মনিরুলের পরাজয়ের পেছনে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী নিজাম উদ্দিনের প্রায় ৩০ হাজার ভোটপ্রাপ্তি একটি বড় কারণ। দুজনই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ফলে সেই ভোট দুজনের বাক্সে ভাগ হয়ে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ভোট এভাবে ভাগ না হলে অধিকাংশ ভোট যেত মনিরুলের বাক্সে। সে ক্ষেত্রে তাঁর পাওয়া ৪৯ হাজার ৯৬৭ ভোটের সঙ্গে আরও ভোট যুক্ত হতো। মেয়র পদে বেসরকারিভাবে জয়ী আরফানুল হক ৫০ হাজার ৩১০ ভোট পেয়েছেন। তাঁদের দুজনের ভোটের পার্থক্য ৩৪৩।
এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) কুমিল্লা জেলার সভাপতি শাহ মো. আলমগীর খান বলেন, বিএনপির ভোট দুই ভাগ হয়ে যাওয়ায় মূলত মনিরুলের পরাজয় হয়। মনিরুল যে ভোট পেয়েছেন, তার অধিকাংশ সাধারণ ভোটারের ভোট। আর নিজাম উদ্দিনের বাক্সে গেছে বিএনপির অধিকাংশ ভোট।
এ ছাড়া মনিরুলের পরাজয়ের কারণ হিসেবে যেসব প্রসঙ্গে উঠে এসেছে, তার মধ্যে রয়েছে নিজের পক্ষের ঘনিষ্ঠ নেতাদের প্রকাশ্যে মাঠে না নামাতে পারা, সাংগঠনিক ব্যর্থতা, ভোটকেন্দ্রে কমসংখ্যক কর্মী থাকা, কোথাও কোথাও এজেন্ট না থাকা, নির্বাচনী প্রচারণায় কিছুটা পিছিয়ে থাকা, দলীয় সমর্থন না পাওয়ার মতো বিষয়। পুরো বিষয়টি থেকে স্পষ্ট, মনিরুলকে ভোটের মাঠে একা এগোতে হয়েছে। দল থেকে মনিরুলকে আজীবন বহিষ্কারের পাশাপাশি তাঁর পক্ষে কোনো ধরনের প্রচারণায় অংশ না নিতে দলের কড়া নির্দেশনা ছিল। ফলে দলীয় কোনো নেতার প্রকাশ্য সমর্থন তিনি পাননি।
এই প্রসঙ্গে সুজন-এর কুমিল্লা জেলার সভাপতি শাহ মো. আলমগীর খান বলেন, বিএনপি থেকে মনিরুলের বহিষ্কারাদেশ এক ধরনের রাজনৈতিক চাপের জন্ম দিয়েছে। দলীয় নেতা-কর্মীরা চাপে পড়ে তাঁর পক্ষে থাকেননি, যা তার পরাজয়ে ভূমিকা রেখেছে।
দুবার মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে মনিরুলের বিরুদ্ধে সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন কাজে অনিয়মের অভিযোগ আছে। এ ছাড়া জলাবদ্ধতা ও যানজট নিরসনে ব্যর্থতা, নতুন ভোটারদের কাছে টানতে না পারা এবং এবারের নির্বাচনে কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনের আনুকূল্য না পাওয়া মনিরুলের পরাজয়ের কারণের তালিকায় আছে।
তবে মনিরুল হকের দাবি, নির্বাচনে তিনি পরাজিত হননি। তাঁর ফল ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। নগরবাসী তাঁকে ভোট দিয়েছেন। নগরবাসীর জন্যই তিনি দল থেকে পদত্যাগ করে নির্বাচন করেছেন, দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন। তিনি এ ফল প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি যদি নির্বাচন না করতাম, নগরবাসী আমাকে ভুল বুঝতেন। প্রায় ১৬ বছর একটানা নগরের দায়িত্বে ছিলাম। আমার কাছে এসে কোনো মানুষ অসম্মানিত হননি। বিরোধী দলের রাজনীতিবিদ হিসেবে চেষ্টা করেছি কুমিল্লার উন্নয়নে কাজ করতে। কাজ করতে গিয়ে ভুলত্রুটি হওয়া স্বাভাবিক। পরাজয়ের কারণ কেন বিশ্লেষণ করব? নির্বাচনের এ ফলই তো আমি প্রত্যাখ্যান করি।’
স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক আহসানুল কবীর বলেন, ‘সাংগঠনিক ব্যর্থতা, কর্মীর অভাব ও তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করতে না পারা মনিরুল হকের পরাজয়ের অন্যতম কারণ বলে আমি মনে করি।’
মনিরুল হক ২০০৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর কুমিল্লা পৌরসভার চেয়ারম্যান পদে প্রথমবার নির্বাচনে অংশ নেন। ওই নির্বাচনে তিনি জয়ী হন। ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে মনিরুল মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ৬৫ হাজার ৫৭৭ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আফজল খানকে তিনি ২৯ হাজার ১০৬ ভোটে পরাজিত করেন। ২০১৭ সালের ৩০ মার্চ কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে দ্বিতীয়বারের মতো তিনি দলীয় প্রতীক ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করেন। ওই নির্বাচনে তিনি ৬৮ হাজার ৯৪৮ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানাকে ১১ হাজার ৮৫ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন।