‘কুনুদিন ঘর ছাড়ছি না, এই প্রথম’

পায়ে হেঁটে গন্তব্যে ছুটছেন মানুষ। গতকাল শনিবার বিকেলে সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার বাওনপুরে
ছবি: প্রথম আলো

প্লাস্টিকের ড্রামে করে কাপ-পিরিচসহ গৃহস্থালির কিছু জিনিস নিয়ে পানি পেরিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন দিলওয়ার হোসেন (৩৪)। বাড়িঘর ডুবে যাওয়ায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গত শুক্রবার থেকেই একটি আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন তিনি। এখন জিনিসপত্র নিয়ে সেদিকে যাচ্ছেন। কেবল তিনি নন, সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার বাওনপুর গ্রামের বেশির ভাগ মানুষই এখন বাড়িছাড়া। অনন্যোপায় হয়ে এসব মানুষ কেউ আশ্রয় নিয়েছেন স্বজনদের বাড়িতে, অন্যরা পার্শ্ববর্তী রশিদপুর গ্রামের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে।

দিলওয়ার হোসেন গতকাল শনিবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাড়িতে পানির বয়স (পানি উঠেছে) তিন দিন। ২০০৪ সালেও পানি আইছিল। কিন্তু ঘরও ওঠেনি। বাড়ির আশপাশে আছিল। রাস্তা মারছিল না (ডোবায়নি)। কুনুদিন আমরা ঘর ছাড়ছি না। এবারই প্রথম ঘর ছাড়লাম।’ তিনি জানালেন, বাওনপুরে প্রায় ১২০টি পরিবারের বাস। সব বাড়িতে, সব ঘরেই এবার পানি ঢুকেছে। কেউই রেহাই পাননি। গ্রামজুড়ে এখন শুধু পানি আর পানি।

স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বাওনপুর গ্রামে বন্যার পানি আসতে শুরু করে। বিকেলের মধ্যে সব ঘরে পানি ঢুকে পড়ে। এরপরও অনেকেই ঝুঁকি নিয়ে এক দিন বাড়িতে থেকেছেন। এরপর শুক্রবার পানিতে ঘর থই থই করায় যে যখন পেরেছেন, ঘর ছেড়েছেন। অনেকেই হাতের কাছে যা পেয়েছেন, তা নিয়েই আশ্রয়ের সন্ধানে বেরিয়েছেন। অনেকেরই ঘরের ভেতর এখন টিভি, ফ্রিজ, খাট, লেপ–তোশক, সংসারের অন্যান্য জিনিস পানিতে ভেসে বেড়াচ্ছে, নয়তো খোলা দরজা-জানালা দিয়ে পানিতে ভেসে গেছে।

ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের রশিদপুর থেকে বিশ্বনাথ কলেজ রোডের দিকে এক-দেড় কিলোমিটার এগোলেই সড়কের দুই পাশজুড়ে দেখা যায় অথৈ পানি। মাঠ, গ্রাম পানিতে ডুবে আছে। বাড়িগুলোর অর্ধেক দেখা যাচ্ছে, বাকি অর্ধেক পানির নিচে। অনেকেই বাড়ি থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে বেরিয়ে আসছেন। বেশির ভাগ বাড়িই নির্জন, মানুষশূন্য। পানির ভয় ধরানো একধরনের স্তব্ধতা চারপাশে। বিশ্বনাথ কলেজ রোড ধরে অনেক মানুষের চলাচল। তাঁদের অনেকে ভেজা কাপড়ে পানি পেরিয়ে শুকনো জনপদের দিকে হাঁটছেন। কেউ নিজের বাড়ি, আত্মীয়স্বজনের খোঁজ নিতে বাওনপুরে এসে থমকে দাঁড়িয়েছেন। অতটুকুই যাওয়া যায়। তার পর থেকে সড়কে পানির স্রোত। কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও ঊরু সমান। দুয়েকজন পানি ঠেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কিছুদূর হাঁটার পর আর যাওয়া সম্ভব হবে না জেনে ফিরে আসছেন।

বৃহস্পতিবার থেকে পরিবারের সঙ্গে আর যোগাযোগ নেই। ওই দিন বিকেলে বলা হয়েছিল পানি আসছে। ঘণ্টাখানেক পর সন্ধ্যার সময় বলা হয়েছে বাড়িতে হাঁটুসমান পানি। এর পর থেকেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।
শিক্ষক নজিবুর রহমান

বাওনপুরে দেখা হালিমা খাতুনসহ একদল নারী ও শিশুর সঙ্গে। হালিমা খাতুন বিশ্বনাথের রামপাশা থেকে আসছিলেন। তিনি বলেন, ‘বাড়িতে পানি। খালার বাড়ি যাইমু (যাবো)। তিন ঘণ্টা ধরি হাঁটরাম।’ দলের অন্যরাও বললেন, তাঁরা কোনো যানবাহন পাননি। অনেক দূর থেকে তাঁরা হেঁটে এসেছেন। দাঁড়িয়ে কথা বলার অবস্থায় নেই কেউ। ক্লান্ত শরীর যেন ভেঙে পড়ছে তাঁদের। অন্যদিকে চলছে অবিরাম বর্ষণ। দুয়েকটি পিকআপ ভ্যান পানিতে ডুবে যাওয়া রাস্তাতেই যাত্রী আনা–নেওয়া করছে। কয়েকগুণ বেশি ভাড়া দিয়ে যাত্রীরা গন্তব্যে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। যারা অত টাকা ভাড়া দিতে পারছেন না, তারা হেঁটে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে বেশির ভাগই যানবাহন পাচ্ছেন না।

এখানেই দেখা হয় শিক্ষক নজিবুর রহমানের সঙ্গে। তাঁর বাড়ি মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার উত্তরভাগ ইউনিয়নের রামপুরে। পানিতে দাঁড়িয়েই কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বিশ্বনাথের দিক থেকে রশিদপুরের দিকে ফিরছিলেন। বিশ্বনাথের রামপাশায় তাঁর শ্বশুরবাড়ি। সেদিকেই যাচ্ছিলেন কিন্তু দেড় কিলোমিটার হাঁটার পর পানির স্রোতের কারণে আর যেতে পারেননি। তিনি জেনেছেন, তাঁর শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার রাস্তায় বুকসমান পানি। নৌকা পাওয়ারও সুযোগ নেই। তাই ফিরে আসছিলেন। শ্বশুরবাড়িতে তাঁর স্ত্রী ও সন্তান অবস্থান করছিল। নজিবুর রহমান বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার থেকে তাঁদের সঙ্গে আর যোগাযোগ নেই। ওই দিন বিকেলে বলা হয়েছিল পানি আসছে। ঘণ্টাখানেক পর সন্ধ্যার সময় বলা হয়েছে বাড়িতে হাঁটুসমান পানি। এর পর থেকেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। তাঁদের সম্পর্কে কিছুই জানতে পারছি না।’

একই জায়গায় দেখা হয় সিলেটের গোয়ালাবাজারের সনজিত বৈদ্যের সঙ্গে। তিনি বিশ্বনাথ বাজারে একটি শোরুমে কাজ করেন। দুপুরে হেঁটে গিয়েছিলেন বিশ্বনাথ বাজারে। আবার হেঁটে ফিরছেন। তিনি প্রথম আলোকে জানালেন, রাস্তায় অনেক স্থানেই হাঁটুপানি। কিছু জায়গায় একটু কম। বিশ্বনাথ বাজারের আশপাশের গ্রামগুলো পানিতে তলিয়ে আছে। বেশির ভাগ বাড়িতেই মানুষ নেই। বাজার এখনো ডোবেনি। তবে বাজারের গরুর হাট ও মাছবাজার পানিতে তলিয়ে গেছে।

গতকাল যখন নজিবুর, সনজিতদের সঙ্গে প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক কথা বলছিলেন, তখন সন্ধ্যা নামছিল। ঘন হয়ে আসছিল অন্ধকার। অন্য দিনের মতো বাড়িঘরের কোথাও আলো জ্বলে ওঠেনি। পানির ভয়াবহ রূপ অন্ধকারে আরও প্রকট হয়ে ওঠে। বাওনপুরের কেউ জানে না, কখন এই পানির কবল থেকে তাঁরা রক্ষা পাবেন।