অভাবের কারণে প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডি পার করতে পারেননি নুরুজ্জামান মিয়া। বেকারত্ব ঘোচাতে পাড়ি জমিয়েছিলেন সৌদি আরবে। পাঁচ বছর পর দেশে ফিরে দেখলেন, এখানে তিনি বেকার। তাই দেশে কিছু করার তাগিদ বোধ করছিলেন। কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের সেই নুরুজ্জামান এখন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে শাহাবুল ব্যাপারী নামে পরিচিত। আট বছর আগে নিজ জেলা ছেড়ে রূপগঞ্জের গোলাকান্দাইল নতুন বাজারে এসেছেন। রূপগঞ্জে তিনি প্রথম গড়ে তোলেন কুঁচিয়া মাছের পাইকারি বাজার।
কুঁচিয়ার ব্যবসা করে নুরুজ্জামানের পরিবারে সচ্ছলতা এসেছে। নিজের ঘর, জমি—সবই হয়েছে। তিন সন্তানের পড়াশোনা চলছে। বন্ধুর পরামর্শে ৫০ হাজার টাকার পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করা নুরুজ্জামান বর্তমানে রূপগঞ্জ থেকে বছরে প্রায় দুই কোটি টাকার কুঁচিয়া রপ্তানি করছেন। নুরুজ্জামান বলেন, ‘বিদেশে অন্যের অধীনে কাজ করতে হতো। এখন আমার অধীনেই কুঁচিয়া আহরণ করে সংসার চালাচ্ছেন প্রায় ৭০ জন শিকারি।’
নুরুজ্জামানের মতো চারজন পাইকার রূপগঞ্জ থেকে প্রতি মাসে প্রায় ১২ টন কুঁচিয়া বিক্রি করছেন রাজধানীর পাইকারি বাজারে। রূপগঞ্জের বিভিন্ন জলাশয় থেকে এসব কুঁচিয়া আহরণ করছেন প্রায় ৩০০ শিকারি। শুধু প্রাকৃতিক উৎস থেকে কুঁচিয়া আহরণ করে বছরে প্রায় ছয় কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছেন রূপগঞ্জের কুঁচিয়া ব্যবসায়ীরা।
রূপগঞ্জের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশেই গোলাকান্দাইল ইউনিয়নের নতুন বাজার। এই বাজার ঘিরেই আশপাশের এলাকায় বসবাস করেন এসব শিকারি। গত ১ জুলাই নতুন বাজার এলাকায় সরেজমিনে কথা হয় নুরুজ্জামানসহ রূপগঞ্জের কয়েকজন কুঁচিয়াশিকারি ও পাইকারের সঙ্গে। তাঁরা জানান, বর্ষা মৌসুমে ‘চাই’ ও ‘ওকা’ দিয়ে কুঁচিয়া আহরণ করা হয়। শুকনা মৌসুমে হাতে কিংবা বড়শিতে কুঁচিয়া শিকার করেন। একজন শিকারি প্রতিদিন গড়ে তিন থেকে চার কেজি কুঁচিয়া আহরণ করতে পারেন। স্থানীয় পাইকারদের কাছে এসব কুঁচিয়া বিক্রি করেন ২০০ থেকে ৩৫০ টাকা কেজি দরে। পাইকারেরা সপ্তাহে দুই দিন বুধ ও শনিবার সেসব কুঁচিয়া মাছ বিক্রি করেন রাজধানীর উত্তরায়। রপ্তানি হয় চীন, হংকং, জাপানসহ বিভিন্ন দেশে।
বংশানুক্রমে প্রায় ৪০ বছর ধরে কুঁচিয়ার ব্যবসা করছেন হবিগঞ্জের পাইকার সনাতন সরকার। রূপগঞ্জে এই ব্যবসায়ের সম্ভাবনা দেখে গত পাঁচ বছর ধরে গোলাকান্দাইলের মাসাবো এলাকায় সপরিবার বসবাস করছেন। মূলত সিলেট ও কিশোরগঞ্জের লোকজন এক দশক ধরে রূপগঞ্জে কুঁচিয়া শিকারের কাজ করছেন বলে জানান তিনি। তাঁদের অনেকেই অন্যান্য কাজের পাশাপাশি বাড়তি আয়ের জন্য কুঁচিয়া আহরণ করেন। নুরুজ্জামান, সনাতন সরকারের পাশাপাশি রূপগঞ্জের কুঁচিয়া রাজধানীতে বিক্রি করেন তালতলা এলাকার সন্তোষ ব্যাপারী ও নতুন বাজারের আমিন মিয়া।
রূপগঞ্জের একটি পোশাক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন ওমর আলী। প্রায় সাত বছর আগে সেই কারখানা বন্ধ হলে চাকরি হারান তিনি। অন্য কোনো কাজ না পেয়ে কুঁচিয়া শিকার শুরু করেন। কুঁচিয়া আহরণ করে দুই সন্তান আর স্ত্রী নিয়ে ভালোভাবেই সংসার চলছে ওমরের। তবে রূপগঞ্জে বিভিন্ন আবাসন কোম্পানির নির্বিচারে জলাশয় ভরাট, জলাশয়গুলোতে বিভিন্ন ডায়িং কারখানার কেমিক্যালমিশ্রিত পানি ছড়িয়ে পড়া এবং বিষ প্রয়োগে মাছ শিকারের কারণে ক্রমশ কুঁচিয়ার প্রাকৃতিক উৎসগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে তিনি শঙ্কিত।
উত্তরার কুঁচিয়া রপ্তানিকারক মোজাম্মেল হক। কুঁচিয়া রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান খুবই ভালো দাবি করে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, এতে যেমন রেমিট্যান্স আসছে, তেমনি বেকার সমস্যা দূর হচ্ছে। তবে শুধু প্রাকৃতিক উৎসের ওপর ভর করে এই ব্যবসায়ের প্রসার তেমন সম্ভব নয়। তার জন্য কুঁচিয়া চাষের প্রতি মনোযোগী হতে হবে। চিংড়ি রপ্তানিকারকদের মতো কুঁচিয়া রপ্তানিকারকদেরও বিশেষ সুবিধা প্রদানসহ খেয়াল রাখতে হবে কুঁচিয়ার প্রজনন মৌসুমে যেন কেউ তা আহরণ না করে। কুঁচিয়া চাষকে বেকারত্ব দূর করার সহজ উপায় বলে মনে করেন এই ব্যবসায়ী।
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জের মৎস্য কর্মকর্তা এনায়েত হোসেন বলেন, ‘মূলত প্রাকৃতিক উৎস থেকে কুঁচিয়া আহরণ করেই আমরা বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছি। তবে এই সম্ভাবনাময় খাতকে এগিয়ে নিতে হলে ব্যাপক মাত্রায় কুঁচিয়া চাষ জরুরি। আমরা কুঁচিয়া চাষে তরুণদের আগ্রহী করে তোলার চেষ্টা করছি।’ জলাশয় ভরাট এবং কেমিক্যালমিশ্রিত পানি জলাশয়ে ছড়িয়ে পড়ায় কুঁচিয়ার প্রাকৃতিক প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রকৃতি থেকে আহরণকৃত ছোট কুঁচিয়া চাষ করে বড় করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে এর বাচ্চা উৎপাদন সম্ভব হয়নি। কুঁচিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ মাছটিকে বাঁচিয়ে রাখতে জলাশয় সুরক্ষা সবচেয়ে বেশি জরুরি।