রংপুরের পীরগঞ্জের বড়করিমপুর গ্রামের সবার চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ। গ্রামটি ঘিরে রেখেছেন পুলিশ ও বিজিবির সদস্যরা। গতকাল রোববার রাত সাড়ে ১০টার দিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের মন্দির ও বসতবাড়িতে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের পর থেকে বাসিন্দারা আতঙ্কে সময় পার করছেন। আগুনে পুড়ে গেছে ২১টি বাড়ির সবকিছু। এ ঘটনায় আজ সোমবার সকাল পর্যন্ত অন্তত ৩০ জনকে আটক করা হয়েছে।
পুলিশ, প্রত্যক্ষদর্শী ও গ্রামের লোকজনের ভাষ্য, পাশের মাঝিপাড়া গ্রামের এক তরুণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ধর্মীয় অবমাননাকর পোস্ট দিয়েছেন—এমন অভিযোগ তুলে একদল লোক সেখানে উত্তেজনা ছড়ানোর চেষ্টা করেন। ঘটনা আঁচ করতে পেরে সম্ভাব্য হামলা ঠেকাতে পুলিশ মাঝিপাড়া গ্রামের ওই তরুণের বাড়িসহ আশপাশের বাড়িতে নিরাপত্তা দেয়। তখন উত্তেজিত শত শত লোক ওই গ্রামের পাশের বড়করিমপুর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী অন্তত ১৫ জনের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর প্রতিবেদকের। তাঁদের ভাষ্য, ধর্মীয় স্লোগান দিয়ে বসতবাড়িতে ঢুকে দুর্বৃত্তরা গ্রামজুড়ে তাণ্ডব চালায়। এ সময় তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে মারধর করে, হুমকি দেয়, অকথ্য ও আপত্তিকর ভাষায় গালাগাল করে। প্রাণ বাঁচাতে নারী, পুরুষ ও শিশুরা বাড়ি ছেড়ে পাশের ধানখেতে আশ্রয় নেয়। দুর্বৃত্তরা তখন একের পর এক বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, হামলাকারীরা গ্রামের বসতবাড়িতে ঢুকে অন্তত আধা ঘণ্টা ধরে তাণ্ডবলীলা চালালেও পুলিশের ভূমিকা দৃশ্যমান ছিল না। হামলাকারীরা চলে যাওয়ার পর পুলিশ গ্রামে গেলে ধানখেতে আশ্রয় নেওয়া লোকজন বাড়িতে ফেরে।
আজ সকাল পৌনে ছয়টার দিকে ওই গ্রামে ঢুকতেই নারী, পুরুষ ও শিশুদের আহাজারি শোনা গেল। নন্দ রানী (২৩) ও তাঁর শাশুড়ি সুমতি রানী (৫৫) বুক চাপড়ে আহাজারি করছিলেন। দেখা গেল, সুমতির তিন ছেলের টিনের চারটি বসতঘর ও ঘরগুলোর ভেতরে থাকা যাবতীয় জিনিস পুড়ে গেছে। আগুনে পুড়েছে তাঁদের দুটি গাভি। যে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় সংসারের চাকা ঘুরত, সেটিও পুড়ে শেষ।
সুমতির ছেলে প্রদীপ চন্দ্র বলেন, রাতে শত শত মানুষ ধর্মীয় স্লোগান দিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়ে। এ সময় দুজন তাঁকে মারধর করলে তিনি দৌড়ে কোনোমতে রক্ষা পান। পরিবারের অন্য সদস্যরাও ভয়ে বাড়ি থেকে চলে যান। হামলাকারীরা ঘরে থাকা ২৫ হাজার টাকা, টিভি ও একটি গরু নিয়ে গেছে। যাওয়ার সময় বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
একটু এগোতেই আরেক বাড়িতে কান্নার শব্দ। ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, একটি শিশু ও এক নারী পোড়া ঘরের বারান্দায় বসে কাঁদছেন। ওই নারীর নাম তারা রানী। শিশু বর্ষা রায় (৯) তাঁর মেয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়িতে ফিরে স্ত্রী-সন্তানকে ব্যর্থ সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন ননী গোপাল রায়। তিনি জানােন, তাঁর চারটি টিনের ঘর, ধান, চাল ও আসবাবপত্র পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তারা রানী আহাজারি করে বলছিলেন, ‘ভগবান, আমরা কী দোষ করছিলাম? কেন আমাদের সব শেষ করে দিল। এখন আমরা কোথায় থাকব, কী করব, কী খাব?’
ননী গোপাল বলেন, তিনি ঘটনার সময় বাড়িসংলগ্ন রাধাগোবিন্দ মন্দিরে পূজা করছিলেন। হঠাৎ শত শত লোক দল বেঁধে বাড়ি ও মন্দিরে ঢুকে আগুন ধরিয়ে দেয়। লুট করে নিয়ে যায় গরু ও স্বর্ণালংকার। পরনের কাপড় ছাড়া সব পুড়ে গেছে। থানায় ফোন করলেও পুলিশের সহযোগিতা পাননি বলে তিনি অভিযোগ করেন।
গ্রামের ক্ষুব্ধ শিরীষ চন্দ্র রায় বলেন, ‘পুলিশ এসেছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের সবকিছু শেষ হওয়ার অনেক পরে। এখন গ্রাম পুলিশে ঠাসা। লাভ কী!’
ওই গ্রামের বাসিন্দা রাসেল মিয়া (৩৫) ঘটনার অভিন্ন বর্ণনা দিয়ে বলেন, হিন্দুদের বাড়িতে হামলা, লুটপাট ও আগুন লাগানোর ঘটনা মর্মান্তিক। এমন নিষ্ঠুরতা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
পূর্ণিমা রানী বলেন, হামলাকারীরা বাড়িতে ঢুকে তাঁর দুই তরুণী মেয়ে কোথায়, তা জানতে চায়। ঘরে ঢুকে ভাঙচুর করে ৫০ হাজার টাকা ও একটি গরু নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। গ্রামের নিরঞ্জন রায় বলেন, ১৫টি পরিবারের ২১টি বসতঘর সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। গ্রামের অন্তত ৫০টি বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। হামলাকারীরা অন্তত ২৫টি গরু ও ১০টি ছাগল নিয়ে গেছে।
পাশের মাঝিপাড়া গ্রামের তরুণ, যার পোস্টকে কেন্দ্র করে সহিংসতা ঘটল; সেই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তালা ঝুলছে। পাশে বসে আছেন অস্ত্রধারী পুলিশ সদস্যরা। এই গ্রামের পুলিন চন্দ্র বলেন, ওই তরুণ ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা গতকাল সন্ধ্যার পর বাড়িতে তালা লাগিয়ে অন্যত্র আত্মগোপন করেছেন।
রংপুরের পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমার সরকার ঘটনাস্থলে উপস্থিত আছেন। তিনি বলেন, হামলাকারীদের কোনো ছাড় নেই। তারা হানাদার বাহিনীর মতো বাড়িঘরে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেছে। ইতিমধ্যে অভিযান চালিয়ে অন্তত ৩০ জনকে আটক করা হয়েছে। এ ঘটনায় থানায় মামলার প্রস্তুতি চলছে।