এই মহামারির মধ্যে সেন্ট মার্টিনে আসা পর্যটকেরা ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধিও মানছেন না। সেন্ট মার্টিন জেটিঘাটে গতকাল দুপুরে
এই মহামারির মধ্যে সেন্ট মার্টিনে আসা পর্যটকেরা ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধিও মানছেন না। সেন্ট মার্টিন জেটিঘাটে গতকাল দুপুরে

সেন্ট মার্টিন দ্বীপ

কাগুজে গণবিজ্ঞপ্তি, স্বাস্থ্যবিধিও নেই

পর্যটকের চাপে পিষ্ট হতে বসা বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনকে রক্ষার জন্য সেখানে ভ্রমণে বিধিনিষেধ আরোপের কথা অনেক দিন থেকেই বলা হচ্ছিল। অবশেষে ২ জানুয়ারি পরিবেশ অধিদপ্তর ১৪ দফা নির্দেশনা–সংবলিত গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে তা প্রচার করা হয়। কিন্তু সেন্ট মার্টিন চলছে আগের মতোই। গতকাল বুধবার সেন্ট মার্টিন ঘুরে দেখা গেল, গণবিজ্ঞপ্তির কিছুই মানা হচ্ছে না সেখানে। পর্যটকদের মধ্যে ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি মানারও বালাই নেই।

‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন’ এলাকা ঘোষণা করে পরিবেশ অধিদপ্তরের জারি করা গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন ও পর্যটকদের অসচেতনতা, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এবং পরিবেশ ও প্রতিবেশবিরোধী আচরণের কারণে সেন্ট মার্টিনের বিরল প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে পৌঁছেছে। দ্বীপটিকে রক্ষায় কিছু বিধিনিষেধ আরোপের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে দ্বীপের সৈকতে সাইকেল, মোটরসাইকেল, রিকশা-ভ্যানসহ কোনো ধরনের যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক বাহন না চালানো, সৈকত, সমুদ্র এবং নাফ নদীতে প্লাস্টিক বা কোনো ধরনের বর্জ্য না ফেলা, দ্বীপের চারপাশে নৌভ্রমণ না করা, জোয়ার-ভাটা এলাকার পাথরের ওপর দিয়ে না হাঁটা, সামুদ্রিক কাছিমের ডিম পাড়ার স্থানে চলাফেরা, রাতে আলো জ্বালানো এবং ফ্ল্যাশলাইট ব্যবহার করে ছবি না তোলা, সৈকতে রাতের বেলা কোনো ধরনের আলো বা আগুন না জ্বালানো, আতশবাজি ও ফানুস না ওড়ানো, মাইক বাজানো, হইচই এবং উচ্চ স্বরে গানবাজনা কিংবা বারবিকিউ পার্টি না করা, সরকারের অধিগ্রহণ করা ছেঁড়াদিয়া দ্বীপে না যাওয়া, জাহাজ থেকে পাখিকে চিপস বা অন্য কোনো খাবার না খাওয়ানোসহ আরও কিছু বিধিনিষেধ। তবে এ গণবিজ্ঞপ্তি প্রতিপালনে কর্তৃপক্ষের কোনো তৎপরতা নেই, পর্যটকেরাও উদাসীন।

গণবিজ্ঞপ্তি মানা হচ্ছে না। পর্যটকদের স্বাস্থ্যবিধিরও বালাই নেই। চেয়ারম্যান বলছেন এটা গণবিরোধী গণবিজ্ঞপ্তি।

বুধবার সকাল সাড়ে আটটায় টেকনাফের দমদমিয়া জেটিঘাট থেকে সাতটি জাহাজে দুই হাজারের বেশি পর্যটক সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশে যাত্রা করেন। কক্সবাজার থেকে একটি জাহাজে আরও সাত শ পর্যটক সেখানে যান। নাফ নদী থেকে ১০টির বেশি কাঠের ট্রলারে চড়ে সেন্ট মার্টিন ভ্রমণে গেছেন আরও পাঁচ শতাধিক মানুষ। সব মিলিয়ে আজ এক দিনেই সেন্ট মার্টিন গেছেন সাড়ে তিন হাজার পর্যটক। শুক্র–শনিবার অথবা ছুটির দিনে পর্যটকদের এ সংখ্যা দ্বিগুণ ছাড়িয়ে যায়।

কেয়ারি সিন্দাবাদ জাহাজে প্রায় ৪০০ পর্যটকের অধিকাংশের মুখে মাস্ক নেই। জাহাজ থেকে আগের মতো করেই পর্যটকেরা চিপস ছুড়ে মারছেন। আর মুহূর্তে গাঙচিল সেই চিপস কামড়ে ধরে গিলে খাচ্ছেন। গাঙচিলের চিপস ও খাবার নিয়ে দৌড়ঝাঁপের ছবি এবং ভিডিও চিত্র ধারণ করছেন অনেকে। অনেকে আবার চিপসের প্যাকেট, খাবারের উচ্ছিষ্টাংশ, পলিথিন পানিতে ফেলছেন। তাঁদের একবার নিষেধ করারও কেউ নেই।

গাঙচিলকে চিপস ছুড়ে মারার নিষেধাজ্ঞার কথা জানেন কি না, প্রশ্ন করা হলে রাজধানীর উত্তরা থেকে ভ্রমণে আসা ব্যবসায়ী ইব্রাহিম আল আজাদ (৩৮) অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। এরপর উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে দেন, ‘চিপস খেলে কি পাখি মরে যায়?’

কেয়ারি সিন্দাবাদের ব্যবস্থাপক মো. শাহ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘গণবিজ্ঞপ্তির ব্যাপারে আমরা যাত্রীদের সচেতন ও সতর্ক করছি, কিন্তু কেউ মানছেন না। ৯৫ শতাংশ পর্যটকের মুখে মাস্ক থাকে না।’

সেন্ট মার্টিনে সাগরে গোসল করে ফিরছেন পর্যটকেরা। গতকাল দুপুরে

গণবিজ্ঞপ্তিতে সেন্ট মার্টিনের সর্বশেষ অংশ ছেঁড়াদিয়ায় পযর্টক যেতে মানা করা হয়েছে। কিন্তু বুধবারও অন্তত ৩০টি স্পিডবোট ও ১২টি নৌকায় ছেঁড়াদিয়ায় গেছেন দেড় হাজারের বেশি পর্যটক। বাধা দেওয়ার কেউ নেই। গণবিজ্ঞপ্তিতে দ্বীপের সৈকতে সব ধরনের যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক যান চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু দেখা গেছে, সেখানে চলছে তিন শতাধিক মোটরসাইকেল, তিন হাজারের মতো সাইকেল ও কয়েক শ তিন চাকার পর্যটকবাহী ভ্যানগাড়ি। লোকজন ঘণ্টা হিসেবে সাইকেল ও মোটরসাইকেল ভাড়া নিয়ে পুরো সৈকত ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এতে সৈকতের রাজকাঁকড়া, শামুক, ঝিনুকসহ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। সৈকত এলাকাও প্লাস্টিক বর্জ্যে ভরপুর। দ্বীপের ১২৪টি হোটেল, ৪০টি কটেজ ও ৫০টির বেশি রেস্তোরাঁয় সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (এসটিপি) নেই। ময়লা–আবর্জনায় দূষিত হচ্ছে সমুদ্রের নীল জলরাশি।

গণবিজ্ঞপ্তি প্রসঙ্গে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ইউপি চেয়ারম্যান নুর আহম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, গণবিজ্ঞপ্তি জারির কথা শুনেছি, কিন্তু বাস্তবায়নের জন্য তাঁকে কেউ লিখিতভাবে জানায়নি। গণবিজ্ঞপ্তিকে গণবিরোধী আখ্যা দিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, ‘পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্লিপ্ততার কারণে গত এক দশকে দ্বীপে প্রায় ২০০ হোটেল-কটেজ তৈরি হয়েছে। এখন তারা হুট করে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছেন কারও সঙ্গে আলোচনা না করেই। এটি কার্যকর হলে দ্বীপের সাড়ে ১০ হাজার মানুষের জীবন–জীবিকা বিপন্ন হবে।’

গণবিজ্ঞপ্তির বিষয়ে কোনো আদেশ না পাওয়ার কথা জানালেন কোস্টগার্ডের সেন্ট মার্টিন স্টেশন কমান্ডার লে. আরিফুজ্জামান ও সেন্ট মার্টিন পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই তারেক রহমান।

গণবিজ্ঞপ্তির বিধিনিষেধ ভাঙলে আইনগত ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তা কার্যকর হচ্ছে না কেন, জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের উপপরিচালক শেখ নাজমুল হক বলেন জনবল–সংকটের কথা। বিধিনিষেধ পুরোপুরি কার্যকর করতে কয়েক মাস সময় লাগতে পারে।