মজুরি বৈষম্য

কর্মঘণ্টা সমান, মজুরি অর্ধেক

দিনে ১০ ঘণ্টা কাজ করে বগুড়ার কৃষি, শিল্পকারখানায় পুরুষের তুলনায় অর্ধেক মজুরি পান নারীরা। নানা কারণে বৈষম্যের প্রতিবাদ করেন না তাঁরা।

ইট তৈরির জন্য ভাটায় আনা মাটি বহনের কাজ করেন নারী শ্রমিকেরা। সারা দিন এ কাজ করে মজুরি মেলে ১১০ থেকে ১৩০ টাকা। গতকাল বগুড়া সদরের বাঘোপাড়া এলাকায়।
ছবি: সোয়েল রানা

১৪ এপ্রিল ভরদুপুর। বৈশাখ মাসের তপ্ত রোদে বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার হরিপুর এলাকার একটি ইটভাটায় মাটি কাটার কাজ করছিলেন আমেনা খাতুন (৩৫)। ট্রাকে করে ভাটায় আনা মাটি ডালিতে ভরে ভাটা পর্যন্ত নিয়ে যান। তপ্ত রোদে সকাল সাতটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত এ কাজ করেন আমেনা। ১০ ঘণ্টার এই কাজ শেষে মজুরি মেলে ১৩০ টাকা।

আমেনা বেগমের সঙ্গে হরিপুর এলাকার ওই ভাটায় মাটি কাটার কাজ করেন মোতালেব হোসেন (৪৫)। একই কাজ করে তাঁর মজুরি ৪০০ টাকা।

দীর্ঘ সময় কাজ করেও কম মজুরি ও বৈষম্যের এমন চিত্র বগুড়া জেলার কয়েক শ ইটভাটায়। পুরুষের সঙ্গে সমান কাজ করেও নারীদের মজুরি প্রায় তিন গুণ কম। এ নিয়ে তাঁরা কখনো আপত্তি করেন না বলে দাবি ভাটার মালিকদের।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বগুড়ায় নারী শ্রমিকদের মজুরির এ বৈষম্যের চিত্র শুধু ইটভাটাতে নয়; কৃষি, খেতখামার, কলকারখানাতেও।

আদমদীঘি উপজেলার শাঁওইল বাজার ঘিরে গড়ে উঠেছে কয়েক শ তাঁত কারখানা। ঝুট কাপড় থেকে রং আলাদাসহ বাছাইয়ের কাজে যুক্ত কয়েক শ নারী ও পুরুষ শ্রমিক।

শাঁওইলের সুতার আড়ত কিংবা তাঁত কারখানায় একজন পুরুষ শ্রমিক কাজ করে মজুরি পান ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। আর নারী শ্রমিকের মজুরি গড়ে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা।

শাঁওইল বাজারের একটি সুতার আড়তে ঝুট বাছাই করেন নারী শ্রমিক বানু বেগম (৪৮)। তাঁর বাড়ি নওগাঁর রানীনগর ইউনিয়নের বেলতা গ্রামে। প্রতিদিন ভোরে এখানে কাজ করতে আসেন তিনি। ১০ বছর ধরে তিনি ঝুট কাপড় বাছাইয়ের কাজ করছেন। সারা দিন কাজ করে মজুরি পান ১৭০ টাকা। যাতায়াত বাবদ তাঁর ৩০ টাকা খরচ হয়।

বানু বেগম বলেন, তাঁর স্বামী রুস্তম আলী পেশায় ভ্যানচালক। বাড়িতে দুই মেয়ে আছে। স্বামীর একার উপার্জনে সংসার ঠিকমতো চলে না। ১০ বছর আগে ৩০ টাকা মজুরিতে এখানে কাজ শুরু করেন। এখন ১৭০ টাকা পেলেও খাওয়া, যাতায়াত বাদ দিয়ে দিনে শ খানেক টাকা হাতে থাকে।

খোদেজা বেগম নামের একজন বলেন, নারী শ্রমিকদের বেশির ভাগই বিধবা, তালাকপ্রাপ্ত ও অসহায়। এ জন্য তাঁদের কম মজুরি দিলেও প্রতিবাদ করার সাহস কারও নেই। সখিনা বেগম নামের একজন বলেন, ঝুট কাপড় বাছাইয়ের এই

কাজ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ঝুট কাপড়ে প্রচুর ধুলাবালু থাকে। অনেকেই অ্যাজমা, শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।

বগুড়ার শেরপুর উপজেলার আমিনপুর মাঠে সম্প্রতি বোরো খেতে কাজ করতে দেখা যায় ক্ষুদ্র জাতিসত্তার কয়েক নারীকে। সকাল-সন্ধ্যা খেতে কাজ করে তাঁদের মাথাপিছু মজুরি ২২০ টাকা। সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জের মাধাইনগর ইউনিয়ন থেকে ওই খেতে কাজ করতে এসেছিলেন লক্ষ্মী রানী মাহাতো (৪০)। তিনি বলেন, তাঁর স্বামী গণেশ মাহাতো মারা যাওয়ার পর থেকে খেতে–খামারে দিনমজুরি দিয়ে সংসার চলে তাঁর।

লক্ষ্মীর মতো রায়গঞ্জ থেকে কাজ করতে আসেন শমরি মাহাতো (৪৮)। তিনি বগুড়ার শেরপুর, নন্দীগ্রাম, ধুনটসহ বিভিন্ন উপজেলায় কাজ করেন। ধানের খেতে নিড়ানি থেকে কাটার কাজ করা শমরি বলেন, মজুরির একটি অংশ যাতায়াতে চলে যায়। এত দূরে না এলে কাজও জোটে না। তাই হাতে যা থাকে, তা দিয়েই সংসার চালাতে হয়।

রায়গঞ্জের নিমগাছি থেকে শেরপুরে কাজ করতে আসা শ্যামলী রানী মাহাতো বলেন, বাড়িতে দুই মেয়ে ও এক ছেলে আছে। সারা দিন কাজ

করে যে মজুরি পান তা দিয়ে সংসার চালাতে খুব কষ্ট হয় তাঁর।

আমার কার্যালয়ের পরিদর্শকেরা বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পকারখানা নিয়মিত পরিদর্শনের সময় শ্রমমজুরির বিষয়টি তদারক করে থাকেন।
মো. ইকবাল হোসাইন, উপমহাপরিদর্শক, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের বগুড়া কার্যালয়

বগুড়ায় নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নারী ও শিশু বিকাশ কেন্দ্রের প্রধান নির্বাহী নিভা রানী পূর্ণিমা বলেন, নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের যত দিন দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতার পরিবর্তন না হবে, তত দিন এভাবে শোষণ ও বৈষম্যের শিকার হতেই থাকবে। একই কর্মঘণ্টা কাজ করে পুরুষেরা যেখানে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা মজুরি পান, সেখানে একই পরিশ্রম দিয়ে নারীরা কম পান কেন? এই নারীনেত্রী বলেন, নারীদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে দিনের পর দিন ঠকানো হচ্ছে। বৈষম্য ঘোচাতে নারীদের প্রতিবাদী হতে হবে, সমান মজুরি আদায়ে সোচ্চার হতে হবে। এর বিকল্প নেই।

নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের যত দিন দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতার পরিবর্তন না হবে, তত দিন এভাবে শোষণ ও বৈষম্যের শিকার হতেই থাকবে।
নিভা রানী পূর্ণিমা, প্রধান নির্বাহী, নারী ও শিশু বিকাশ কেন্দ্র, বগুড়া

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের বগুড়া কার্যালয়ের উপমহাপরিদর্শক মো. ইকবাল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার কার্যালয়ের পরিদর্শকেরা বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পকারখানা নিয়মিত পরিদর্শনের সময় শ্রমমজুরির বিষয়টি তদারক করে থাকেন। মজুরিবৈষম্যের অভিযোগ পেলে প্রথমে কারখানামালিকদের সতর্ক করে দেওয়া হয়। এতে কাজ না হলে শ্রম আইনে মামলা করা হয়। নারীদের মজুরিবৈষম্যের বিষয়ে অভিযোগ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’