কামাল আহমদে চৌধুরী ঢাকা মহানগর জেনারেল কোভিড হাসপাতালের একজন চিকিৎসক। রোববার রাতে তিনি হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করেন। সোমবার ঈদের দিন সকালে তাঁর দায়িত্ব পালন শেষ হয়। এরপর তিনি গিয়ে উঠেছেন নয়াপল্টনের ক্যাপিটাল হোটেলে। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ঈদের দিনও পরিবারের সঙ্গে তিনি থাকতে পারেননি। এই হোটেলে কোয়ারেন্টিনে তাঁকে আরও ১৪ দিন থাকতে হবে।
চিকিৎসক কামাল আহমদে চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মেয়ে আদিনার বয়স আট বছর। এই প্রথম ঈদ আমার পরিবারের সঙ্গে কাটাতে পারলাম না। আমার মেয়ে আমাকে বলেছে, “বাবা, তুমি আজ বাসায় আসবে না?” আমি তাকে বলেছি, করোনা চলে গেলে স্থায়ীভাবে বাসায় আসতে পারব। ঈদের এই সময়ে পরিবার পরিজন ছাড়া আগে কখনো এমন সময় কাটেনি।'
চিকিৎসক কামাল আহমদে চৌধুরীর মতো আরও অনেক চিকিৎসক ঈদের এই করোনাকালে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে পারছেন না। এক দল চিকিৎসক হাসপাতালে কোভিড রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে চলেছেন। আরেক দল চিকিৎসকের হোটেলে কোয়ারেন্টিনে কাটছে সময়।
ঢাকার তিনটি কোভিড হাসপাতালের সাতজন চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এসব হাসপাতালে ১০দিন দায়িত্ব পালন করার পর ১৪ দিন হোটেলে কোয়ারেন্টিনে থাকেন। মাসে মাত্র ছয় দিন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে থাকার সময় পাচ্ছেন তাঁরা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার হাসপাতালের অনেক চিকিৎসক কোয়ারেন্টিনে আছেন। অবস্থান করছেন হোটেলে। ঈদের দিনও পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে পারেননি। করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার সঙ্গে জড়িত চিকিৎসককে ১০ দিন দায়িত্ব পালন করার পর ১৪ দিন হোটেলে থাকতে হয়। মাসে মাত্র ছয় দিন পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে পারছেন। কঠিন এক সময় পার করছেন চিকিৎসকেরা।’
এ কে এম নাসির উদ্দিন জানান, পার্সোনাল প্রোটেকশন ইক্যুইপমেন্টসহ (পিপিই) সব ধরনের সুরক্ষা নিয়ে দায়িত্ব পালন করার পরও কিন্তু তাঁর হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন। জীবন হাতে নিয়ে কাজ করছেন চিকিৎসকেরা। দিনদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজে করোনা রোগী বাড়ছে। রোগীদের চিকিৎসা সেবার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের প্রত্যেককে হোটেলে থাকতে হচ্ছে। পরিবার-পরিজন ছাড়া হোটেলে থেকে চিকিৎসকেরা মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
ঈদের দিন কোভিড হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করা এবং হোটেলে কোয়ারেন্টিনে থাকা একাধিক চিকিৎসক জানান, ঈদের দিনেও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তাঁরা সময় কাটাতে পারেননি। তাঁদের নিয়ে পরিবারের সদস্যরা অনেক দুশ্চিন্তায় থাকেন। এ জন্য পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়মিত মুঠোফোনে কথা বলেন।
করোনা রোগীদের চিকিৎসাকেন্দ্র ঢাকার মুগদা সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক সুশান্ত বিশ্বাস। কোভিড রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার পর রাজধানীর পল্টনের একটি হোটেলে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে ছিলেন তিনি। সম্প্রতি তিনি বাসায় ফিরেছেন। দু-এক দিনের মধ্যে আবার কাজে যোগ দেবেন।
চিকিৎসক সুশান্ত বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার বিশেষ সময়ে একজন চিকিৎসক হিসেবে মানুষকে সেবা দিতে পারছি, এটা আমার জীবনের অনেক বড় পাওয়া। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছি। ১০ দিন চিকিৎসা দেওয়ার পর ১৪ দিন হোটেলে অবস্থান করেছি। এখন আমি বাসায় অবস্থান করছি।’
ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক প্রকাশ চন্দ্র রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোভিড হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ডবয়সহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী অনেক কঠিন সময় পার করছেন। যাঁরা হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন, তাঁদের নিয়ে পরিবারের সদস্যরা সারাক্ষণ টেনশনে থাকেন। আমার হাসপাতালের চিকিৎসকেরা তিনটি স্থানে থেকে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। পালাক্রমে তাঁরা চিকিৎসা দিচ্ছেন।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক চিকিৎসক এস এম রাশেদ উল ইসলাম। শুরু থেকেই তিনি হাসপাতালটির করোনা শনাক্তকরণ ল্যাবরেটরিতে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিনই ল্যাবরেটরিতে দায়িত্ব পালন করছেন কেউ না কেউ। প্রতিদিনের পরীক্ষার ফলাফল আমরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠিয়ে দিই। দেশের এই ক্রান্তিকালে মানুষের জন্য কিছুটা হলেও করতে পারছি, এটা আমার জীবনের অনেক বড় পাওয়া।’
বিএসএমএমইউর ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সাইফ উল্লাহ মুন্সি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঈদের দিনও আমাদের ল্যাবরেটরিতে কাজ হয়েছে। বাস্তবতা হলো, করোনার এই সময়ে চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যরা যাঁর যাঁর জায়গা থেকে কাজ করে যাচ্ছেন। করোনার নমুনা সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। বহু চিকিৎসক করোনায় সংক্রমিত হচ্ছেন। মারাও গেছেন। বিষয়টি আমাদের সবারই মনে রাখা উচিত।'
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা মেনে চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। ঈদের দিন তিনি নিজেও অফিস করেছেন, দায়িত্ব পালন করেছেন। করোনার সংক্রমণ এড়াতে সবাই যেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন।