করোনায় দরিদ্রদের পাশে এবার তেমন কেউ নেই

গতকালও ছোটখাটো জটলা দেখা গেল উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ের সামনে। ত্রাণ পাওয়ার আশায় ভিড় জমিয়েছিলেন গরিব–অসহায় মানুষ।

ঠাকুরগাঁও জেলা
ঠাকুরগাঁও জেলা

কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেও কয়েক দিন ধরে সকালে ঠাকুরগাঁও শহরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদের কার্যালয়সহ রাজনৈতিক নেতা ও বিত্তশালীদের বাড়ির সামনে দুস্থ ও অসহায় মানুষের ভিড় চোখে পড়ল। খাদ্যসহায়তার আশায় কয়েক ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করতে দেখা যায় তাঁদের।

গতকাল সোমবারও এমনই ছোটখাটো জটলা দেখা গেল উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ের সামনে। ত্রাণ পাওয়ার আশায় ভিড় জমিয়েছিলেন জনা দশেক গরিব–অসহায় মানুষ। জানতে চাইলে একজন বললেন, তিন দিন ধরে ঘরে খাবার নেই। ত্রাণের আশায় এখানে অপেক্ষা করছেন।

সকালে শহরের কেন্দ্রীয় বাস ট্রার্মিনালের সামনে দাঁড়িয়ে কথা হয় বাসচালকের সহকারী বেলাল হোসেনের (৪৭) সঙ্গে। করোনা পরিস্থিতিতে কঠোর বিধিনিষেধের কারণে গণপরিবহন বন্ধ। বন্ধ তাঁর আয়ও। তাঁর পরিবারের সদস্যরা অর্ধাহারে–অনাহারে আছেন। খাদ্যসহায়তার আশায় তিনি বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বেলাল বললেন, ‘করোনার জন্য গাড়ির চাকা বন্ধ। আমাদেরও কাম নাই। ঘরেও চাউল নাই। সমিতির মাইনষে কিস্তি চায়। ঘরে পাঁচজন মানুষ। তিন দিন ধরে না খায়ে থাকার মতো অবস্থা।’

শহরের রিকশাচালক হাসনাত আলী (৪৫), আবদুল আজিজ (৫২), হোটেলশ্রমিক মো. পারভেজসহ অনেক খেটে খাওয়া মানুষেরও একই অবস্থা।

করোনার শুরুর দিকে গত বছর বিধিনিষেধ চলাকালে কাজ হারানো এসব মানুষের পাশে খাদ্যপণ্য নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন সরকার, রাজনৈতিক দল, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনসহ অনেক ব্যক্তি। কিন্তু চলতি বিধিনিষেধে দু–একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ছাড়া তেমন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।

সদর উপজেলার তেলিপাড়া গ্রামের পরিবহন শ্রমিক রওশন আলী (৪৪) বলেন, তাঁর পরিবারের সদস্যসংখ্যা পাঁচ। অন্যের সাহায্য নিয়ে সংসার চালান। লকডাউনের জন্য মানুষের সাহায্য বন্ধ। তাই একটু ত্রাণের আশায় এদিক–ওদিক যাচ্ছেন তিনি।

সদরের কালিতলা গ্রামের মায়া বেগমের (৫৭) স্বামী নেই। ছেলেদের সংসারে থাকেন। তিনি বলেন, লকডাউনে তাঁদের (ছেলেদের) সংসারই চলে না। তাই তাঁকে খাবারের খোঁজে বের হতে হয়েছে। কিন্তু ইউএনও অফিস, নেতাদের বাড়ি কোথাও গিয়ে খাবারের ব্যবস্থা করতে পারলেন না।

করোনা সংক্রমণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় গত ১৭ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত জেলায় ঢিলেঢালা বিধেনিষেধ শুরু হয়। তবে এতে শ্রমজীবী মানুষের তেমন বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু ১ জুলাই থেকে সারা দেশে কঠোর বিধিনিষেধ শুরু হওয়ার পর খেটে খাওয়া অভাবী লোকজন বিপাকে পড়েছেন।

শহরের কিছু তরুণের নেতৃত্বে ‘হাসিমুখ’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ব্যানারে কর্মহীন মানুষের জন্য ৫০ শতাংশ ভর্তুকির দোকান খোলা হয়েছে। সেখান থেকে নিম্ন আয়ের মানুষ চাল, ডাল, লবণ, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারছেন।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকারঘোষিত কঠোর বিধিনিষেধে ঠাকুরগাঁও শহরে যানবাহন ও মানুষের চলাচল সীমিতই ছিল। কিন্তু গতকাল সকাল থেকে মানুষের সমাগম খানিকটা বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে রিকশা ও ইজিবাইকের সংখ্যাও। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে তল্লাশি চালিয়েছে।

বিধিনিষেধের মধ্যে খেটে খাওয়া অনেক মানুষের দুমুঠো ডালভাত খেয়ে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। এমনই এক রিকশাচালক আকচা গ্রামের ওলিউর রহমান (৫৪)। তিনি বলেন, ‘এমন অবস্থা হইছে, ছোয়াপোয়া নিয়া না খায়ে থাকার অবস্থা। রিকশা নিয়ে পুলিশের সামনে পড়লেই ধরে নিয়ে যায়। তারপরও বের হইছি। আমরা যে না খেয়ে আছি তা কেউ দেখে না। খালি বিধিনিষেধ দিলেই চলবে? আমাদেরও পেটে খাবার দিতে হবে।’

করোনায় ত্রাণের উদ্যোগ বিষয়ে জেলা বিএনপির সভাপতি মো. তৈমুর রহমান বলেন, ‘বিএনপি একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল। দায়িত্বশীল দল হিসেবে আমাদের যে দায়িত্ব সে দায়িত্ব পালন করছি। দলের অনেক নেতা-কর্মী কর্মহীন হয়ে পড়েছে। আবার অনেকে করোনায় আক্রান্ত। আমরা সীমিতভাবে তাদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি।’

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দীপক কুমার রায় জানালেন, তাঁর বাড়িতেও গরিব, অসহায় অনেকে এসেছেন সাহায্যের আশায়। সবাইকে পারেননি। তবে কয়েকজনকে তিনি সহায়তা করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা সব সময় দেশের মানুষের পাশে ছিলাম, এখনো আছি। এবার দলীয়ভাবে না হলেও ব্যক্তিগতভাবে কষ্টে থাকা মানুষের কাছে খাদ্যপণ্য পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।’

জেলা প্রশাসক মাহবুবুর রহমান বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে কর্মহীন মানুষের জন্য দু–এক দিনের মধ্যে খাদ্যপণ্য বিতরণ করা শুরু হবে।