মহামারির এই দুর্যোগে অনেকের হাতে কাজ নেই। শ্রমজীবীরা হয়ে পড়েছেন অসহায়। কম দামে পণ্য কিনতে মানুষ লাইন দিচ্ছেন টিসিবির ট্রাকের পেছনে। কিন্তু রংপুরে পণ্য বিক্রয়কেন্দ্র কমে গেছে। এ তথ্য অনেকেই জানেন না। ফলে পণ্য কিনতে তাঁদের দূরদূরান্তে যেতে হচ্ছে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) রংপুর কার্যালয় সূত্র বলছে, ঈদের পর টিসিবির পণ্য বিক্রি হওয়ার কথা ছিল না। এরপরও কেন্দ্রের নির্দেশে সীমিত আকারে গত ২৬ জুলাই থেকে ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রি শুরু হয়েছে। ঈদের আগে ১৬টি কেন্দ্র ছিল, এখন তা কমিয়ে ৯টি করা হয়েছে।
গতকাল সোমবার রংপুর প্রেসক্লাবের সামনে ন্যায্যমূল্যে টিসিবির পণ্য কিনতে এসেছিলেন আলেয়া বেগম (৭১)। তিনি প্রায় চার কিলোমিটার পথ হেঁটে এসেছেন। এত দূরের পথ হেঁটে এসে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেননি। ছায়ায় বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলেন। আলেয়ার বাড়ি নগরের রবার্টসনগঞ্জ এলাকায়। তিনি বলেন, ‘কোনো কোনো দিন আমাদের এলাকাত এই ট্রাক যাইত। কিন্তু আইজ (আজ) নাই। একটু আগেয়া দেখি শাপলা চত্বরত নাই। আর একনা (একটু) আগেয়া দেখি গ্রান্ড হোটেল মোড়তও নাই। এমন করিয়া আগাইতে আগাইতে প্রেসক্লাব এলাকাত আসি ট্রাক পাছি। কিন্তু এই গরমোত হাঁটতে হাঁটতে শরীরটা ভাঙি গেল।’
বেলা দেড়টা থেকে রংপুরে টিসিবির পণ্য বিক্রি শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু অনেক আগে থেকেই ক্রেতাদের ভিড় লেগে যায়। গাড়ি আসার আগে আগে লাইনে দাঁড়িয়ে যান তাঁরা।
রংপুর নগরের প্রেসক্লাব এলাকাসহ আরও কিছু এলাকায় ট্রাকে টিসিবির ন্যায্যমূল্যে চিনি, মসুর ডাল ও সয়াবিন তেল বিক্রি করা হচ্ছে। প্রেসক্লাব ছাড়া টিসিবির বাকি আটটি বিক্রয়কেন্দ্র হলো কাছারি বাজার (পোস্ট অফিসের সামনে), সিটি বাজারের সামনে, তাজহাট টিসিবি কার্যালয়ের সামনে, বারো আউলিয়া, বাবু খাঁ, খাসবাগ, নজিরের হাট, মনোহর এলাকা।
প্রেসক্লাব এলাকায় লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন বইয়ের দোকানের এক কর্মচারী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই ব্যক্তি বলেন, ‘দোকান বন্ধ। মাঝেমধ্যে খোলা থাকলেও বই বিক্রি নেই। অনেক কষ্টে থাকতে হচ্ছে। টিসিবির পণ্য প্রায়ই কিনি। ৩টি পণ্য কিনে বাজার থেকে প্রায় ১১০ টাকা কম পড়ল।’
নগরের কাছারি বাজার এলাকায় টিসিবির পণ্য কিনতে এসেছিলেন এক ব্যক্তি। তিনি অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক। তিনি বলেন, স্ত্রীসহ তিনজনের ছোট সংসার। তাই চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে। করোনার আগে বিভিন্ন প্রসাধনসামগ্রী দোকানে দোকানে পৌঁছে দিতেন। দুজন কর্মচারীও ছিলেন। এখন এসব বন্ধ হয়ে গেছে। আয়রোজগারও নেই। জমানো টাকা দিয়ে নিত্যপণ্য কিনতে এখানে এসেছেন।
এদিকে অন্য একটি কেন্দ্র নগরের কাছারি বাজার এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, ট্রাক আসার অনেক আগে থেকেই পণ্য কিনতে নারী-পুরুষেরা জটলা করছেন। কথা হয় নগরের জলকর এলাকা থেকে দুই কিলোমিটার পথ হেঁটে আসা রোকসানা বেগমের (৫৫) সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘কম পয়সায় জিনিস (পণ্য) পাওয়া যায় বলিয়া এটে আসছি।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নগরে কেরানিপাড়া এলাকার একজন বলেন, ‘ছেলেমেয়েরা লজ্জায় এখানে এসে লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য কিনতে চায় না বলে নিজেই এসেছি।’
টিসিবি রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্র জানায়, নগরে ১৬টি কেন্দ্র ছিল। ঈদের পর তা কমিয়ে ৯টি করা হয়েছে। এসব স্থানে ট্রাকে করে দুপুর থেকে ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রি হচ্ছে। টিসিবির চিনির কেজি ৫৫ টাকা, মসুর ডালের কেজি ৫৫ টাকা, সয়াবিন তেল (প্রতি লিটার) ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একেকটি ট্রাকে প্রতিদিন ৩০০ কেজি চিনি, ২০০ কেজি ডাল ও ৬০০ লিটার তেল বিক্রি করা হচ্ছে। শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহের ছয় দিন এসব পণ্য বিক্রি চলে।
এদিকে গতকাল এসব পণ্যের বাজারমূল্য ছিল চিনি (প্রতি কেজি) ৭২-৭৮ টাকা, মসুর ডাল প্রকারভেদে ৮০-১২০ টাকা, সয়াবিন তেল (প্রতি লিটার) ১৪০-১৫০ টাকা।
কেন্দ্র কমে যাওয়া প্রসঙ্গে টিসিবি রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ের আঞ্চলিক কর্মকর্তা প্রতাপ কুমার প্রথম আলোকে বলেন, এটি প্রধান কার্যালয়ের সিদ্ধান্ত। ঈদের পর পণ্য বিক্রি হওয়ার কথা ছিল না। করোনার দুর্যোগের কারণে তা শুরু করা হয়েছে। কেন্দ্র আরও বাড়তে পারে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।