দক্ষিণের তিন চেকপোস্টে করোনাভাইরাস নিয়ে সতর্কতা

সাতক্ষীরার ভোমরা সীমান্তের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা চলছে। গতকালের ছবি। প্রথম আলো
সাতক্ষীরার ভোমরা সীমান্তের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা চলছে। গতকালের ছবি।  প্রথম আলো

চীনসহ কয়েকটি দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দেওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের তিনটি অভিবাসন চেকপোস্ট—যশোরের বেনাপোল, সাতক্ষীরার ভোমরা ও চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় বাড়তি সতর্কতা জারি করা হয়েছে। ঝুঁকি নির্ণয়কেন্দ্রে স্থাপন করা হয়েছে।

যশোরের বেনাপোল অভিবাসন তল্লাশিচৌকি দিয়ে গত ১০ দিনে দেশে ভারত থেকে আসা চার হাজার যাত্রীকে পরীক্ষার আওতায় আনা হয়েছে। কিন্তু কারও শরীরে এই ভাইরাসের লক্ষণ দেখা যায়নি—যদিও করোনাভাইরাস নির্ণয়ে উন্নত মানের যন্ত্রপাতি নেই। মানবদেহের তাপমাত্রা মাপার থার্মো স্ক্যানারের মনিটর দীর্ঘদিন ধরে বিকল পড়ে রয়েছে। যে কারণে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময় সংকেত দেওয়া ব্যক্তির ছবি মনিটরে দেখা যাচ্ছে না। এতে  সময় ও লোকবল বেশি লাগছে। এ কারণে পরীক্ষা-নিরীক্ষা কাজ কিছুটা বিঘ্নিত হচ্ছে।

জানতে চাইলে যশোরের সিভিল সার্জন শেখ আবু শাহীন বলেন, ‘থার্মো স্ক্যানার যন্ত্রের মনিটর মেরামতের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। কিন্তু আমাদের জানানো হয়েছে, দেশে এ স্ক্যানারের এই মনিটর মেরামতের কোনো কারিগর নেই। মনিটরটি বিদেশে পাঠিয়ে মেরামত করতে হবে। যে কারণে মনিটরটি স্থানীয়ভাবে মেরামত করা যাচ্ছে না।’

বেনাপোলের পরীক্ষা দলের সদস্য কমিউনিটি উপসহকারী চিকিৎসা কর্মকর্তা আবদুল মজিদ বলেন, ভারত থেকে বাংলাদেশে ঢোকার শুরুতেই থার্মো স্ক্যানার যন্ত্র বসানো আছে। ওই যন্ত্রের নিচ দিয়ে যাত্রীরা দেশে প্রবেশের সময় শরীরের তাপমাত্রা মাপা হয়। কারও শরীরের তাপমাত্রা ৯৮ দশমিক ৪ ডিগ্রির ওপরে থাকলে যন্ত্র সংকেত পাঠায়। ওই ব্যক্তি ছবি মনিটরে ভেসে ওঠে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে মনিটরটি নষ্ট হয়ে। এতে ওই ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে পুনরায় হ্যান্ড স্ক্যানার দিয়ে পরীক্ষা করতে হচ্ছে। এতে সময় বেশি লাগছে।

বেনাপোল ইমিগ্রেশন সূত্রে জানা গেছে, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ১৯ জানুয়ারি থেকে ভারত থেকে বাংলাদেশে আসা পাসপোর্টধারী যাত্রীদের ভাইরাসের লক্ষণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। যাত্রীদের শরীরের তাপমাত্রা, সর্দি-হাঁচি-কাশি, নিউমোনিয়া, ত্বকে লাল লাল র‌্যাশ (প্রদাহ) আছে কি না, তা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। এরপর যাত্রীদের দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে।

যশোর জেনারেল হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় যশোর জেনারেল হাসপাতালে চারটি পৃথক কেবিনের একটি ইউনিট প্রস্তুত করে রাখা আছে। যশোর মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক গৌতম আচার্যকে প্রধান করে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে।

এ বিষয়ে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক দিলীপ কুমার রায় বলেন, ‘কারও শরীরে করোনাভাইরাসের লক্ষণ দেখা গেলে তাকে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হবে। এ বিষয়ে সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে।’

চুয়াডাঙ্গার দর্শনা চেকপোস্টে করোনাভাইরাস স্ক্রিনিংয়ে নিয়োজিত চিকিৎসা দল চার দিন ধরে কাজ করছে। তাদের ভরসা কেবল প্রেসার মাপার যন্ত্র স্টেথিস্কোপ ও জ্বর মাপার থার্মোমিটার। তবে দলের সদস্যদের নিরাপদ পোশাক ও স্ক্রিনিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই।

গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে সরেজমিনে দেখা যায়, অভিবাসন ও শুল্ক বিভাগের তল্লাশিচৌকির সামনে খোলা মাঠে তাঁবু টানিয়ে স্থাপন করা হয়েছে চিকিৎসা দলের কেন্দ্র। ভারত থেকে আসা পাসপোর্টধারী যাত্রীদের অভিবাসন ও শুল্ক বিভাগের তল্লাশির আগে মুখোমুখি হতে হচ্ছে চিকিৎসা দলের। চার সদস্যের চিকিৎসা দলের সদস্যরা হলেন চিকিৎসা কর্মকর্তা শাকিল আর সালান ও তানভীর মো. আসিফ মুজতবা এবং উপসহকারী কমিউনিটি চিকিৎসা কর্মকর্তা ওয়াশীম আলী ও সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক মো. শাহ জামাল।

চিকিৎসা দলের তাঁবুতে বসেই কথা হয় চীনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রমিজ রেজুয়ান আহমেদের সঙ্গে। তিনি জানান, ৯ জানুয়ারি চীন থেকে ফিরেছেন। গত বুধবার জরুরি কাজে ভারত ভ্রমণে যান এবং বৃহস্পতিবার ফেরেন। তাঁর বাড়ি চুয়াডাঙ্গার জীবননগরে। অন্যান্য যাত্রীর মতো তাঁর বুকে স্টেথিস্কোপ ও মাথায় হাত দিয়ে স্ক্রিনিং করা হয়।

ওয়াশীম আলী জানান, স্টেথিস্কোপ দিয়ে ফুসফুস ও থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর পরীক্ষা করা হচ্ছে। নির্দেশনা আছে কারও বিষয়ে সন্দেহ থাকলে তাঁকে সদর হাসপাতালে পাঠাতে। এখনো কাউকে পাঠানো হয়নি।

সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন হুসাইন শাফায়াত জানান, বুধবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নির্দেশ পাওয়ার পর ভোমরা স্থলবন্দরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সেখানে পর্যাক্রমে ২১ জন স্বাস্থ্যকর্মী ছাড়াও স্বেচ্ছাসেবকেরা কাজ করছেন। 

অভিবাসন বিভাগের উপপরিদর্শক বিশ্বজিৎ সরকার জানান, করোনাভাইরাস সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষ জানে না। ভারতীয় লোকজন পরীক্ষাও করাতে চায় না। ভারত থেকে যেসব বাংলাদেশি ফিরে আসেন, তাঁরা পরীক্ষা করার ব্যাপারে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। তাঁরা বলেন, ভারতে কোনো ধরনের পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। অথচ এখানে পরীক্ষা করতে হবে কেন।

সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী (৪৫) সপ্তাহখানেক আগে কলকাতায় গিয়েছিলেন। গতকাল বেলা সাড়ে তিনটার দিকে ফিরেছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ভোমরা সীমান্তের বিপরীতে ভারতের ঘোজাডাঙ্গা সীমান্তে এসব নিয়ে কেউ কিছু জানে না। দেশে ফেরার পর জোর করে পরীক্ষা করানো হচ্ছে।

ভারতের চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাট মহকুমার বসিরহাট শহরের বিমল কৃষ্ণ সরকার, কলকাতার বনগাঁও এলাকার মিলন পাল ও হুগলি জেলার প্রভাত কুমার দাশ জানান, করোনাভাইরাস সম্পর্কে তাঁরা কিছু জানেন না। তাঁদের দেশে কোনো ধরনের সতর্ক কিংবা পরীক্ষা করা হচ্ছে না।

সাতক্ষীরা ভোমরা সীমান্তের বন্দর এলাকায় কর্মরত চিকিৎসা দলের সদস্য স্যানিটরি ইন্সপেক্টর আবুল কাসেম জানান, দুজন উপসহকারী কমিউনিটি চিকিৎসা কর্মকর্তা ও একজন স্যানিটারি ইন্সপেক্টরের সমন্বয়ে পাঁচ সদস্যের চিকিৎসা দল প্রতিদিন সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত কাজ করছেন। ভারত থেকে যেসব যাত্রী আসছেন, তাঁদের থার্মালস্ক্যানার দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা দেখা হচ্ছে। শরীরের তাপমাত্রা ৯৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে হলে তাঁদের অন্যান্য উপসর্গ দেখা হবে। কিন্তু গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত এ ধরনের কাউকে শনাক্ত করা যায়নি।

সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন হুসাইন শাফায়াত জানান, প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসেবে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে চিকিৎসার জন্য একটি বিশেষ স্থান ঠিক করে পাঁচটি শয্যা রাখা হয়েছে। পাপাপাশি সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে লিফলেট বিলি করা হচ্ছে।