শখ ছিল ছবি আঁকা ও আবৃত্তি করা। পড়ছেন রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে, দ্বিতীয় বর্ষে। ক্লাস-পড়শোনায় ভুলেই থাকতে হয় ছবি আঁকার কথা। করোনাকালে ছুটির ফাঁকে সুপ্ত প্রতিভা জেগে ওঠে। তিনি সুতা দিয়ে তৈরি করেন পাখি, পাখির বাসা, কাঠের গহনা, কাপড়ের নকশাসহ আরও অনেক কিছু। খুলে ফেলেন একটি ফেসবুক পেইজ। মিলে যায় ক্রেতা। চলছে বেশ। এই তিনি রাফা তাবাসসুম। বাড়ি রাজশাহী নগরের রামচন্দ্রপুর এলাকায়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও টিউশনি বন্ধের এই সময়ে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই একইভাবে নিজের সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে রীতিমতো আয় করছেন নূরানী ফেরদৌস ও সুমি মুর্মুও। এই বন্ধের মধ্যে তাঁরাও নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেছেন। নূরানী করছেন শাড়ির কাজ। আর সুমি করছেন নকশি কাঁথা। ঘরে বসেই তাঁরা আয় করার উপায় বের করে ফেলেছেন।
সম্প্রতি নগরের রামচন্দ্রপুর এলাকায় রাফা তাবাসসুমের বাসায় গিয়ে কথা হয় তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। বাবা শামছুল হক কলেজ শিক্ষক। তাঁর শখ ছিল মেয়েকে চিকিৎসক বানাবেন। তাই এইচএসসি পাস করার পর মেডিকেল কোচিং করালেন। কিন্তু মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ হয়নি। এ নিয়ে পরিবারের সবার মন খারাপ। তবে কয়েকদিন পরেই রুয়েটে ভর্তির সুযোগ পান রাফা।
বাবা বললেন, ‘বুঝতে পারিনি যে মেয়ের ভেতরে একটা শিল্পী মন আছে। চিকিৎসক হওয়ার ব্যাপারে তাঁর উৎসাহ ছিল না। সৃজনশীল কাজের ব্যাপারে আগ্রহ ছিল। শেষ পর্যন্ত তারই জয় হয়েছে। প্রস্তুতি ছাড়া পরীক্ষা দিয়েই সে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ পেয়েছে। করোনাকালের এই বন্ধের মধ্যে এখন সে তার শিল্পকর্ম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।’
রাফার কাজের মধ্যে মনকাড়া একটা জিনিস হচ্ছে, শুধু্ই সুতা আর আঠা দিয়ে তেরি করেছেন বাবুই পাখির বাসা। তাতে বসে আছে দুটি পাখি। রং-বেরঙের সুতা দিয়ে পাখির শরীরের বিভিন্ন অংশে রং ফুটিয়ে তুলেছেন। শো–পিস হিসেবে বাসায় রাখার মতো জিনিস। একইভাবে সুতা দিয়েই তৈরি করেছেন কানের দুল ও অন্যান্য অলংকার। কাঠ দিয়ে তৈরি করেছেন নানা রকম অলঙ্কার। শুধু কাগজ দিয়ে তৈরি করেছেন কলাদানি, ফুলদানি ও আরও কয়েকটি জিনিস। প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা না থাকলেও রীতিমতো রং-তুলি দিয়ে থ্রি-পিস ও চাদরে নকশা করছেন। ফেসবুক পেইজের সুবাদে ঘরে বসেই এগুলো বিক্রি করছেন। রাফা বলেন, তাঁর হাতের তৈরি কোনো জিনিস আর পড়ে থাকছে না।
নূরানী ফেরদৌস (২৫) অর্থনীতি বিষয়ে মাস্টার্স শেষ করে বিসিএস কোচিং করছিলেন। থাকেন রাজশাহী নগরের টিকাপাড়া এলাকায়। কোভিড-১৯ এর কারণে কোচিং বন্ধ। বাসায় বসে সময় কাটে না। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও তিনি মনের খেয়ালে আঁকাআঁকি করতেন। এবার তিনিও রং-তুলি হাতে তুলে নিয়েছেন। কাপড়ে তুলির আঁচড় দেওয়ার চেষ্টা করেন। কয়েক দিনের মধ্যে নতুন শাড়িতে নকশা এঁকে ফেলেন। সেই শাড়ির ক্রেতাও পেয়ে যান। গত সাড়ে পাঁচ মাসে তিনি প্রায় অর্ধশত শাড়ি বিক্রি করেছেন। ১৯ সেপ্টেম্বর তাঁর বাসায় গিয়ে দেখা যায়, তিনি রং-তুলিতে শাড়িতে নকশা করতে ব্যস্ত।
নূরানী বলেন, তাঁর অধিকাংশ শাড়ির নকশা নিজের উদ্ভাবিত। একটার সঙ্গে আরেকটা মিলবে না। প্রত্যেকটাই নতুন। তিনি দুই দিনেই একটি শাড়ি করে ফেলেন। ফেসবুকে তাঁর এই শাড়ির নকশা দেখে পরিচিত লোকজন প্রথমে কেনার আগ্রহ প্রকাশ করেন। মজার ব্যাপার তাঁর সবগুলো শাড়িই বিক্রি হয়ে গেছে। এখন আর তার দম ফেলার সময় নেই। ফেসবুকে তাঁকে Nuranye Fardush নামে পাওয়া যায়।
সুমি মুর্মু থাকেন রাজশাহী নগরের কয়েরদাঁড়া খ্রীস্টানপাড়া এলাকায়। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে মাস্টার্স করেছেন। চাকরি নিয়েছিলেন একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে। পাশাপাশি টিউশনি করতেন। তাঁর ছোট ভাইও টিউশনি করতেন। দুই ভাইবোনের এই আয়ে চলত সংসার। পরিবারের সদস্য সংখ্যা সাত। করোনা পরিস্থিতির কারণে তাঁর স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। একই সঙ্গে তাঁদের টিউশনিও বন্ধ হয়ে গেছে। পরিবার নিয়ে বিপাকে পড়েন তিনি।
বছরখানেক আগে থেকে সুমি সময় পেলেই নকশি কাঁথা নিয়ে বসতেন। এখন করোনাকালে নকশি কাঁথাই তাঁর পরিবারের বেঁচে থাকার অবলম্বন হয়ে উঠেছে। তাঁর কাঁথা যাচ্ছে খাগড়াছড়ি থেকে দিনাজপুর পর্যন্ত। খাগড়াছড়িতে পাঠিয়েছেন বাসে। আর দিনাজপুরে পাঠিয়েছেন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে। তবে এলাকার পরিচিত মানুষের মধ্যে তাঁর কাঁথা বেশি বিক্রি হয়েছে। এক হাজার ৮০০ টাকা থেকে চার হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে এসব কাঁথা। কাজের চাপ বেড়ে যাওয়ার কারণে তিনি এ কাজের সঙ্গে আরও সাতজন মেয়েকে যুক্ত করেছেন।
বাসায় গিয়ে দেখা যায়, একটি কক্ষে তৈরি করা কাঁথা সাজিয়ে রাখার জন্য তাক তৈরি করেছেন। সেই কক্ষের মেঝেতেই সবাই বসে কাঁথা সেলাই করছেন। তাঁর সঙ্গে কাজ করতে দেখা গেল একই এলাকার শিলা মুর্মু, এলিজাবেথ হাসদা, শিউলি মুর্মু, শম্পা হেম্ব্রম, বার্থলোমিও কিসকু, দিপালী বিশ্বাস ও মারসেলা সরেনকে। কোনো ফরমায়েসের কাঁথা তাড়াতাড়ি করে দেওয়ার জন্য তাঁরা কয়েকজন মিলে একটি কাঁথা করেন। ভারী নকশা হলে তিনজনে মিলে করেন। আর সচরাচর দুইজন মিলে করেন। ১২ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে তাঁরা একটি কাঁথা সেলাই করে ফেলেন।
একটি কাঁথা থেকে তাঁরা ছয় শ টাকা থেকে সাড়ে নয় শ টাকা পর্যন্ত আয় করেন। গৃহস্থালির কাজের ফাঁকে ফাঁকে তাঁরা এ কাজ করেন। সুমি নিজেই সবকিছুর নকশা তৈরি করেন। তিনি বলেন, শুধু কাঁথা নয়, ক্রেতার দিক থেকে সাড়া পেয়ে তিনি থ্রি-পিস, বিছানার চাদর ও বালিশের কাভারও তৈরি করছেন। তাঁর কাছে আট-দশ রকমের কাঁথা দেখা গেল। তাঁর বিছানার চাদর আর বালিসের কাভারগুলোর নকশাও বেশ নজরকাড়া।
সুমি বললেন, এখন যেগুলো দেখছেন, এগুলো সবই বিক্রি হয়ে গেছে। শুধু ক্রেতাদের কাছে পাঠাতে হবে। সুমি জানালেন, তাঁর সহকর্মীদের হাত চালু হয়ে গেছে। এখন আরও কম সময়ে তাঁরা একটা কাজ তুলে দিতে পারবেন। আর সব মিলে ঘরের বাইরে না গিয়েই তিনি এখন সংসারটা চালিয়ে নিতে পারছেন।