করোনার ঝুঁকিতে গত মার্চে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে গেল। ম্যাকলিন চাকমা সেই সময়ই ফিরলেন গ্রামে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এ শিক্ষার্থীর নিজ গ্রাম হাজাছড়া। এটি পার্বত্য জেলা রাঙামাটির বরকল উপজেলার একটি গ্রাম। প্রায় ৪০০ মানুষের বাস। সব বাসিন্দাই চাকমা জাতিসত্তার। উপজেলা সদর থেকে এখানে পৌঁছাতে যন্ত্রচালিত নৌকায় চলে যায় ঘণ্টা দেড়েক। গ্রামে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। হাইস্কুল বেশ দূরে। এ জনপদে এখনো পৌঁছায়নি বিদ্যুৎ।
লকডাউনের পর ম্যাকলিনের মতো বাইরে পড়ুয়া এ গ্রামের একাধিক শিক্ষার্থী গ্রামে ফেরেন। দিন যেতে থাকে, সপ্তাহ ফুরায়। প্রায় মাস চলে যায়। আর গ্রামের স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা বই থেকে দূরে যেতে থাকে। কেউ কেউ বাবা–মার সঙ্গে জুমের খেতে যাওয়া শুরু করে। টেলিভিশনে ক্লাস শুরু হয়েছিল বটে। কিন্তু দূর পাহাড়ের, বিদ্যুৎহীন গ্রামটিতে টেলিভিশনের ক্লাস তো নাগালের বাইরে। ম্যাকলিন বলছিলেন, ‘দেখলাম এভাবে চলতে থাকলে ছেলে–মেয়েগুলো একেবারে পিছিয়ে পড়বে। হয়তো কেউ একেবারে ঝরে পড়বে শিক্ষা থেকে। কিছু একটা করতে হবে, ওদের লেখাপড়ায় ফেরাতে হবে।’
তাই তৈরি হলো ‘পহর ছিদোক’। চাকমা ভাষায় যার অর্থ হলো ‘আলোকচ্ছটা ছড়িয়ে পড়ুক’।
প্রথম থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বিনা পয়সায় পড়ানোর জন্য হাজাছড়া গ্রামের কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের প্রয়াস ‘পহর ছিদোক’। এসব পাহাড়ি তরুণ শিক্ষার্থী স্থানীয় সংগঠন হিল রিসোর্স সেন্টারের সঙ্গে জড়িত।
চারদিকে করোনাভাইরাসের প্রকোপ। এর মধ্যে অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানদের ‘পহর ছিদোক’ কোচিং সেন্টারে আসতে দিতে চাননি শুরুতে। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং গণ্যমান্যদের সহযোগিতায় অভিভাবকদের বোঝানো হলো। বলা হলো, করোনার প্রকোপ হাজাছড়া গ্রামে নেই। আর গ্রামে বাইরের মানুষেরও আনাগোনা নেই। তাই পরিবেশটা অনেকটা নিরাপদ। সেখানে শিক্ষাদান সমস্যা হবে না।
এ উদ্যোগে আছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী দীপন চাকমা। তিনি বললেন, ‘অভিভাবকেরা আমাদের কথায় আশ্বস্ত হলেন। তাঁরা সন্তানদের পাঠানো শুরু করলেন। গ্রামে ইউনিসেফের একটি স্কুলঘর ছিল। সেটা ব্যবহারে অনুমতি পেলাম। তারপর পাঠদান আরম্ভ হলো।’
সপ্তাহের শনি থেকে বুধবার পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৭টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত পাঠদান কার্যক্রম চলছে। প্রথম থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি নিজেদের মাতৃভাষা চাকমা ভাষার বর্ণমালাও শেখানো হচ্ছে। এ ছাড়া হাতের সুন্দর লেখা প্রতিযোগিতা, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হয়। এ কোচিংয়ে এখন লেখাপড়া করছে হাজাছড়া গ্রামসহ আশপাশের তিন–চারটি গ্রামের ৫২ জন শিক্ষার্থী।
পহর ছিদোক নামের এই সামাজিক উদ্যোগে জড়িয়ে আছেন ১০–১২ জন। যখন যিনি সময় পান তখন ক্লাস নেন। কিন্তু শুধু লেখাপড়ায় সীমাবদ্ধ নেই তরুণদের এই উদ্যোগ। তাঁদের ‘সোশ্যাল ইনোভেশন টিমের’ উদ্যোগে গ্রামে একটি মুদিদোকান চালু হয়েছে। উদ্যোক্তারা জানান, গ্রামে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে দরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা।
ইনোভেশন টিমের অন্যতম সদস্য সতেজ চাকমা বলেন, ‘হাজাছড়া গ্রাম এবং তার আশপাশের কোথাও কোনো মুদিদোকান নেই। প্রয়োজনীয় সামগ্রীর জন্য এলাকার লোকজনকে নৌকায় করে সুবলং বাজার নয়তো রাঙামাটি সদরের বনরূপার বাজারে যেতে হয়। এতে সংক্রমণের ঝুঁকির মাত্রা বেশি। এ ঝুঁকি কমানোর জন্যই মূলত আমাদের এই উদ্যোগ।’
চাল, ডাল, তেল, লবণসহ চাকমা নারীদের পিনোন খাদিও মেলে এ দোকানে। আছে খাতা–কলমসহ নানা শিক্ষা উপকরণ।
গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি অমল বিকাশ চাকমা বলছিলেন, ‘বাজারের যে মূল্য এর চেয়ে বেশি এক পয়সাও নেয় না ওরা।’
এ উদ্যোগ নিয়ে হিল রিসোর্স সেন্টারের পরিচালক চন্দ্রা ত্রিপুরা বলেন, ‘হাজাছড়ার তরুণদের কোচিংয়ের উদ্যোগটির সঙ্গে আমার সমর্থন ও যোগাযোগ ছিল সার্বক্ষণিক। কার্যক্রমটি পরিচালিত হচ্ছে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাসেবার ভিত্তিতে। একে আরও দীর্ঘস্থায়ী এবং টেকসই করার উদ্দেশ্যে এই ইনোভেশন টিম আরও কিছু আয়বর্ধনমূলক উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। আর সে উদ্যোগের অংশ হিসেবে পাহাড়ি কিছু অর্কিডের চারা সংগ্রহ করে হোম নার্সারি করা হয়েছে। এগুলো শিগগিরই বাজারজাত করা হবে।
ইতিমধ্যে বন থেকে পাঁচ শতাধিক অর্কিডের চারা সংগ্রহ করে সেটা নার্সারিতে পরিচর্যা করা হচ্ছে। এই অর্থ দিয়ে পরিচালিত হবে এই কোচিং কার্যক্রম এবং বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষামূলক উদ্যোগ।
করোনার কারণে অধিকাংশ মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে আছে। হাজাছড়ার তরুণেরা ভেবেছেন সেসব নিয়েও। সে জন্য কিছু মানসিক ও স্বাস্থ্য সুরক্ষামূলক কার্যক্রমও নেওয়া হয়েছে। যার জন্য এই কোচিংয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য গান, নাচ ও খেলাধুলার আয়োজন করা হয়েছে।
ইনোভেশন টিমের অন্যতম সদস্য ক্যজসাইন মারমা বলেন, ‘আমাদের ইনোভেশন টিমের মূল লক্ষ্য পাহাড়ের প্রত্যন্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ কঠিন সময়ে আত্মবিশ্বাস ও স্থিতিশীলতা তৈরি করা। যাতে তারা এই করোনার সময় বা তার পরবর্তী দিনগুলো সহজে সামলে উঠতে পারে।’
গ্রামের বড় ভাই–বোনদের কাছে বিনা পয়সায় পড়তে পারছে বরনিকা চাকমা। তবে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রীর কাছে এটাই বড় পাওয়া নয়—বড় পাওয়া, পহর ছিদোকে আনন্দে পড়তে পারা।
শিশুদের এই আনন্দ শুধু না। এসব তরুণ পুরো গ্রামকেই দিয়েছে এক নিরাপদ পরিবেশ। গ্রামের বাসিন্দা কৃপাধন চাকমা বলছিলেন, ‘ওরা আমাদের ছেলে–মেয়েদের শিক্ষার দায়িত্বই শুধু নেয়নি। গ্রামকে রোগমুক্ত রাখতে দোকানের ব্যবস্থা করেছে। আমাদের নিরাপত্তা দিয়েছে। এ পর্যন্ত হাজাছড়া গ্রামে করোনায় আক্রান্ত হয়নি কেউ।’
জানা গেল, হাজাছড়ার এ উদ্যোগ দেখে পাশের গ্রাম মনোআদামের তরুণেরা গ্রামের স্কুলের শিশুদের পাঠদানের উদ্যোগ নিয়েছেন। অমল বিকাশ চাকমা বলছিলেন, ‘পহর ছিদোকের আলো হাজাছড়া গ্রাম ছাড়িয়ে অন্যত্র যাচ্ছে।’