আমন ধান ওঠার আগে নভেম্বরের শুরুর দিকে নওগাঁর হাটবাজারে ধানের দাম ছিল চড়া। কৃষকদের আশা ছিল, আমন ধানের দামও এবার হয়তো ভালো পাওয়া যাবে। কিন্তু বাজারে আমনের সরবরাহ বাড়তে থাকায় পাল্টে গেছে বাজারের চিত্র। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে নওগাঁর বিভিন্ন হাটবাজারে নতুন ধানের দাম প্রতি মণে ১০০-১২০ টাকা পর্যন্ত কমেছে। বোরোর পর আমন ধানের বাজারও মন্দা হওয়ায় কৃষকেরা চরম হতাশ হয়ে পড়েছেন।
তবে নওগাঁর বিভিন্ন চালের মোকামে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ধানের দাম কমলেও চাল আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জেলা কার্যালয় থেকে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে জেলায় ১ লাখ ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে আমনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। আর চাষ হয়েছে ১ লাখ ৯০ হাজার হেক্টর জমিতে। জেলায় মোট আমনচাষির সংখ্যা ৭৭ হাজার ২২৫। এ বছর ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১২ লাখ ৬৭৪ মেট্রিক টন।
নওগাঁর অন্যতম বড় ধানের মোকাম পত্নীতলা উপজেলার মধইল বাজার। ওই বাজারে সপ্তাহের প্রতিদিন ধান কেনাবেচা হয়। গতকাল শুক্রবার সকালে ওই বাজারের আড়তদার ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারটিতে প্রতি মণ মোটা জাতের স্বর্ণা-৫ ও স্বর্ণা-৫১ (হাইব্রিড স্বর্ণা) ধান মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ৬১০ টাকায়। সরু জাতের শম্পা কাটারি ধান বিক্রি হচ্ছে ৯৫০ থেকে ৯৮০ টাকায়।
পত্নীতলা উপজেলার আকবরপুর গ্রামের কৃষক সাইফুল ইসলাম (৫৫) বাজারে এসেছিলেন ধান বিক্রি করতে। কত টাকায় ধান বিক্রি করলেন—জানতে চাইলে মলিন মুখে তিনি বলেন, ‘সেই কথা আর বলো না বাবা। ১০ মণ স্বর্ণা ধান অ্যানিছিনু। প্রতি মণ ধান মাত্র ৬০০ টাকা দিয়ে বিক্রি করনু (করলাম)। সেই টাকাও আবার বাকি। আড়তদার বলিচ্ছে, দুই-তিন পর টাকা দিবে। কিন্তু টাকাটা হামার আজকাই (আজকে) দরকার ছিল। বাড়িত কিছু তরি-তরকারি কিনা লাগবে, সেই টাকা পর্যন্ত পকেটত নাই। গত ইরি-বোরো সময়েও এই রকম সমস্যায় পড়িছিনু। এভাবে চললে হামরা কৃষকেরা বাঁচমু ক্যামনে।’
দেলোয়ার হোসেন নামের এক কৃষক বলেন, ‘ধান আবাদ করে হামাগেরে গলাত কাঁটা লেগে গেছে। ৬০০ টাকা হিসেবে ধান বিক্রি করায় প্রতি মণ আমন ধানে কম হলেও ১৫০ টাকা লোকসান হবে। কৃষকের দিকে চ্যায়ে দ্যাখে না কেউ। কৃষকেরা লোকসান গুনতে গুনতে নিঃস্ব হয়ে গেলেও কারও কিছু আসে যায় না।’
আড়তদার শহিদুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে বাজারে ধানের দাম কমছে। গত এক-দেড় সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি মণ ধানের দাম ১০০ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত কমেছে। নতুন ধান ওঠার শুরুতে স্বর্ণা জাতের ধান ৭০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। কিন্তু এখন সেই ধান ৬০০ থেকে ৬১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। শম্পা কাটারি ধানের দাম ১ হাজার ৫০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। কিন্তু সেই ধানও দাম কমতে কমতে ৯৫০ থেকে ৯৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
আরও বেশ কয়েকজন ধানের আড়তদার জানান, চালকলের মালিকেরা ধান কেনা কমিয়ে দেওয়ায় তাঁরা কৃষকদের কাছে ধান কিনছেন কম। কিন্তু এখন বাজারে ধানের সরবরাহ বেড়ে গেছে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি হওয়ায় ধানের দাম কমে গেছে।’
ধান কেনা কমিয়ে দেওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে জেলা চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বলেন, ‘অন্যান্য অনেক ব্যবসার মতো চালকলের মালিকদের ব্যবসাও সাইক্লিং পদ্ধতিতে চলে। অর্থাৎ চাল বিক্রি করে টাকা পেলে সেই টাকা দিয়ে চালকলমালিকেরা ধান কিনে থাকেন। কিন্তু এই মুহূর্তে মোকামে চাল বিক্রি কমে গেছে। চাল বিক্রি করতে না পারায় চালকলমালিকেরা ধান কিনতে পারছেন না। এ জন্য বাজারে ধানের দাম কমে গেছে। তবে সরকার কৃষকদের লাভবান করতে ৬ লাখ মেট্রিক টন ধান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারের ধান সংগ্রহ অভিযান পুরোদমে শুরু হলে বাজারে হয়তো কিছুটা প্রভাব পড়ত। কিন্তু এখন পর্যন্ত নওগাঁয় ধান সংগ্রহ অভিযান শুরুই হয়নি।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২৬ টাকা কেজি দরে জেলায় ১৯ হাজার ৫৮০ মেট্রিক টন ধান কেনার কার্যক্রম শুরুই হয়নি। জেলার নিয়ামতপুর, বদলগাছী ও ধামইরহাট উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নে লটারির মাধ্যমে কৃষক নির্বাচন করা হলেও এখনো ধান সংগ্রহ শুরু হয়নি। এ ছাড়া অধিকাংশ ইউনিয়নে কৃষকদের কাছ থেকে তালিকা না পাওয়ায় লটারিই করা হয়নি।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক গোলাম ফারুক হোসেন পাটোয়ারি বলেন, নওগাঁর ১১টি উপজেলার মধ্যে সদর উপজেলা ছাড়া ১০টি উপজেলায় লটারির মাধ্যমে কৃষক নির্বাচন করে ধান সংগ্রহ করা হবে। সদর উপজেলায় অনলাইনে আবেদনের মাধ্যমে কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করা হবে। প্রশাসনের কাছ থেকে তালিকা না পাওয়ায় ধান সংগ্রহ অভিযান শুরু করতে দেরি হচ্ছে। তবে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে তাঁরা আশা করছেন সব ইউনিয়নে ধান সংগ্রহ অভিযান পুরোদমে শুরু করা যাবে।