কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের সুগন্ধা পয়েন্ট। আজ শুক্রবার বেলা ১১টা। বৈরী পরিবেশের কারণে সাগর কিছুটা উত্তাল। সৈকতের এক কিলোমিটারে গিজগিজ করছে অন্তত ১৫ হাজার পর্যটক। সুগন্ধার উত্তরে সিগাল ও লাবণী পয়েন্টের দুই কিলোমিটারের আছে আরও ১০ হাজার। আবার উত্তর দিকের কলাতলী পয়েন্টের এক কিলোমিটারে রয়েছে আরও ছয় হাজার পর্যটক। সব মিলিয়ে ৪ কিলোমিটার সৈকতে সকালেই সমাগম ঘটেছে ৩০ হাজারের বেশি পর্যটকের। সুগন্ধা সৈকতে ১৫ হাজার পর্যটকের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন বেসরকারি সংস্থা সি-সেফের মাত্র ৩ জন লাইফগার্ড কর্মী।
সুগন্ধার উত্তর ও দক্ষিণ পাশে লাবণী, সিগাল ও কলাতলী পয়েন্টে আছেন আরও কয়েকজন লাইফগার্ড। পাঁচটি ওয়াচ টাওয়ারে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের দিকে নজরদারি করেন আরও কয়েকজন লাইফগার্ড। কয়েকজন লাইফগার্ড থাকেন পানিতে। কোনো পর্যটককে ভেসে যেতে দেখলে ওয়াচ টাওয়ার থেকে বাজানো হয় বাঁশি, তারপর চলে উদ্ধার তৎপরতা।
ট্যুরিস্ট পুলিশ ও সি-সেফ লাইফগার্ডের কর্মীদের তথ্যমতে, বিকেল চারটা নাগাদ পর্যটকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখে। পাঁচ শতাধিক হোটেল-মোটেলের ৯০ শতাংশ কক্ষ বুকিং হয়ে গেছে।
কক্সবাজার হোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বলেন, বছরজুড়ে সৈকতে পর্যটকের আগমন ঘটলেও ব্যবসা হয় মূলত নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ এই পাঁচ মাস। পাঁচ মাসের ১৫০ দিনের মধ্যে অন্তত ৬০ দিন ১ লাখ করে পর্যটক থাকেন হোটেলগুলোতে। সে হিসাবে বছরে ৬০-৭০ লাখ পর্যটক সৈকত ভ্রমণে আসেন। কিন্তু নানা কারণে চলতি মৌসুমে পর্যটকের সংখ্যা কমেছে। গত নভেম্বর থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত ভ্রমণে এসেছেন ৩০-৩৫ লাখ পর্যটক। একজন পর্যটকের বিপরীতে থাকা, খাওয়া, কেনাকাটা, ভ্রমণসহ আনুষঙ্গিক খরচ ৩ হাজার টাকা ধরলে ৩৫ লাখ পর্যটক দৈনিক খরচ করেছেন ১০০ কোটি টাকার বেশি। এ ছাড়া শুঁটকি, মৎস্য, লবণ, শামুক, ঝিনুক পণ্যসহ পর্যটন খাতে বছরে ব্যবসা হচ্ছে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এখান থেকে সরকার রাজস্ব পাচ্ছে ৭০০ কোটির বেশি। অথচ এখানে পর্যটকের নিরাপত্তা-বিনোদনের তেমন কিছু নেই।
পর্যটন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, সৈকত দখল করে তৈরি হয় দোকানপাট, সৈকতে ঘোড়া, বিচবাইক, চেয়ার-ছাতা (কিটকট), জেডস্কির ব্যবসা, ভ্রাম্যমাণ আলোকচিত্রী, চা-কফি বিক্রির ভ্রাম্যমাণ দোকান, ভাজা মাছ বিক্রির দোকানপাট চলে ভাড়া দিয়েই। অথচ সৈকতের উন্নয়ন নেই তেমন। সন্ধ্যার পর সৈকত ডুবে থাকে অন্ধকারে। সৈকত তীরের ঝাউবাগানের ভেতরে পর্যটক যেতে পারেন না, ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে হারাতে হয় সর্বস্ব। মাদকের রমরমা বাণিজ্য চলে ঝাউবাগান, সৈকত পাড়সহ হোটেল-মোটেল জোনে। তবু পকেটের টাকা খরচ করে পর্যটকেরা দল বেঁধে ছুটে আসছেন কক্সবাজারে।
পর্যটকেরা সৈকত ভ্রমণের পাশাপাশি ছুটছেন মেরিন ড্রাইভ দিয়ে ইনানীর পাথুরে সৈকত, টেকনাফ সৈকত, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, রামুর বৌদ্ধপল্লি, চকরিয়ার ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, মহেশখালীর আদিনাথ মন্দিরসহ বিভিন্ন স্থানে।
হোটেলের মালিকেরা বলছেন, সৈকতে কোনো পর্যটক নিখোঁজ হলে উদ্ধারের জন্য একজন ডুবুরিও নেই। চার কিলোমিটারে ভেসে যাওয়া পর্যটকদের উদ্ধারে একটি বেসরকারি সংস্থার ২৭ জন লাইফগার্ড থাকলেও অবশিষ্ট ১১৬ কিলোমিটার সৈকতে অরক্ষিত পড়ে আছে। সৈকতের কোথাও নিরাপদ গোসলের ব্যবস্থা নেই। নেই বিনোদন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা।
বেলা ১১টায় সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে গোসলে নেমে হইচই করছিলেন কয়েকজন তরুণ। হঠাৎ ঢেউয়ের ধাক্কায় হারিয়ে যান সোহেল নামের একজন তরুণ। মুহূর্তে লাইফগার্ড কর্মীরা তাঁকে উদ্ধার করে আনেন। সোহেলের বন্ধু জয়নাল বলেন, বিপদ কখন আসে, টের পাওয়া যায় না। লাইফগার্ড না এলে নিশ্চিত মৃত্যু হতো সোহেলের।
ঢাকার মগবাজার থেকে এসেছেন ব্যবসায়ী সানা উল্লাহ (৪৫)। তিনি বললেন, চার কিলোমিটার সৈকতে ৩০ হাজার পর্যটক নামলেও তাঁদের নিরাপত্তায় আছেন ছয়জন লাইফগার্ড। অথচ সরকারিভাবে ডুবুরি, মেডিকেল টিম, অ্যাম্বুলেন্স, অক্সিজেন সবকিছু থাকার কথা। পর্যটকের অনেকের সাঁতার জানা থাকে না। ঢেউয়ের ধাক্কায় হারিয়ে গেলে উদ্ধারের জন্য বিশ্বের দীর্ঘতম সৈকতে ডুবুরি নেই, ভাবতে অবাক লাগছে।
সি-সেফ লাইফগার্ডের ব্যবস্থাপনা তত্ত্বাবধায়ক সাইফুল্লাহ সিফাত বলেন, লাইফগার্ডের কাজ হচ্ছে ভেসে যাওয়া বিপদাপন্ন পর্যটকদের দ্রুত উদ্ধার করা এবং পর্যটকদের সমুদ্র নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতন করা। জোয়ার-ভাটার তথ্য জানানো। কিন্তু গোসলে নেমে কেউ নিখোঁজ হলে কিংবা সমুদ্রের তলদেশে গুপ্তখাল কিংবা চোরাবালিতে আটকা পড়ে মারা গেলে উদ্ধারের দায়িত্ব ডুবুরি দলের। ডুবুরি আর লাইফগার্ডের কাজ এক নয়।
পর্যটকদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মুহিউদ্দিন বলেন, গুপ্তখালে কিংবা চোরাবালিতে আটকা পড়া পর্যটককে উদ্ধারে কোনো ডুবুরি সৈকতে নেই। প্রয়োজন পড়লে চট্টগ্রাম থেকে ডেকে আনতে হয়। কক্সবাজার ফায়ার সার্ভিসেও ডুবুরি নেই। সৈকতের ট্যুরিস্ট পুলিশের একাধিক বক্সে (পোস্ট) প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও স্বাস্থ্য বিভাগের স্থায়ী মেডিকেল টিম নেই।
লাইফগার্ড ও ট্যুরিস্ট পুলিশ জানায়, এখন মুমূর্ষু অবস্থায় কোনো পর্যটক উদ্ধার হলে তাঁকে দুই কিলোমিটার দূরের কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয় ইজিবাইক (টমটম) কিংবা বালুচরে দৌড়ানোর ছোট্ট বিচবাইক দিয়ে। অক্সিজেনও থাকে না ঘটনাস্থলে। ফলে হাসপাতালে পৌঁছার আগেই অনেকের মৃত্যু হচ্ছে। আবার লাইফগার্ডের কর্মীরা বালুচরে রেখে মুমূর্ষু রোগীর পেট চেপে মুখ দিয়ে পানি বের করার চেষ্টা করলে ঝামেলা বাধে। ঘটনাস্থলে চিকিৎসক থাকলে এ সমস্যা দেখা দিত না। প্রাণহানির ঝুঁকিও কমত।
সি-সেফ লাইফগার্ডের তথ্য, গত পাঁচ বছরে ৪ কিলোমিটারের এই সৈকত থেকে উদ্ধার হয়েছে ৬ জন পর্যটকসহ ২৫ জনের লাশ। ভেসে যাওয়ার সময় জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ৩৮৫ জন পর্যটককে। এর মধ্যে ১৫ শতাংশ নারী।
১৯৯৫ সালের ২৩ অক্টোবর সকালে ঢাকার কলেজছাত্র মিনহাজ উদ্দিন ইয়াছির নামের ২২ বছরের এক তরুণ সৈকতে গোসল করতে নেমে মারা যান। এরপর ইয়াছিরের বাবা শাহাবুদ্দিন সৈকতে ভেসে যাওয়া মানুষকে উদ্ধার করার জন্য ডানকানের আর্থিক সহযোগিতায় গড়ে তোলেন ‘ইয়াছির লাইফগার্ড স্টেশন’। ২০১০ সাল পর্যন্ত ১৪ বছরে ইয়াছির লাইফগার্ডরা সৈকতের চার কিলোমিটার থেকে ৯৮ জনের মরদেহ উদ্ধার করেন। এর মধ্যে পর্যটক ৬২ জন। জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করেন পাঁচ হাজারের বেশি পর্যটক। ৬২ পর্যটকের মধ্যে একাই ৫০ জনকে উদ্ধার করেছিলেন নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ডুবুরি ও লাইফগার্ডটির পরিচালক মোস্তফা কামাল।
মোস্তফা কামাল বলেন, ডুবুরির কাজ সমুদ্রের তলদেশে ডুব দিয়ে মরদেহের সন্ধান অথবা তল্লাশি করা। ডুবুরির পিঠে বাঁধা থাকে ‘স্টুভা সেট’ নামে অক্সিজেন সিলিন্ডার আর মুখে থাকে মাস্ক ও লাইফলাইন (রশি)। গুপ্তখালে কিংবা চোরাবালিতে লাশ পাওয়া গেলে হাত অথবা পা ধরে টেনে নিয়ে আসেন ডুবুরি। আর লাইফগার্ডরা গোসলের সময় ভেসে গেলে বড়জোর তাঁকে উদ্ধার করে প্রাণে রক্ষা করতে পারেন। কক্সবাজার সৈকতে ডুবুরি নেই।
এ ব্যাপারে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) আবু সুফিয়ান বলেন, এখন যে লাইফগার্ডরা আছেন, তাঁদের সবার ডুবুরির প্রশিক্ষণ আছে, কিন্তু সাগরের তলদেশে গিয়ে ঘণ্টাখানেক সময় ডুবে থাকার সরঞ্জাম নেই। ডুবুরি নিয়োগের পরিকল্পনাও নেই জেলা প্রশাসনের। তবে সৈকতের লাবণী, সুগন্ধা ও কলাতলী পয়েন্টে অ্যাম্বুলেন্স থাকে। স্থায়ী মেডিকেল টিম নেই জানিয়ে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, টানা কয়েক দিনের ছুটি পেলে লাখো পর্যটকের সমাগম ঘটে সৈকতে, তখন মেডিকেল টিমের দরকার পড়ে। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত শিগগিরই হবে।