কক্সবাজারের উখিয়ার আশ্রয়শিবির থেকে আজ বুধবার নোয়াখালীর ভাসানচরের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে ১২৬ পরিবারের ২৫৭ জন রোহিঙ্গা। বেলা সোয়া ১১টায় উখিয়া ডিগ্রি কলেজ মাঠের অস্থায়ী প্রত্যাবাসনকেন্দ্র থেকে রোহিঙ্গাদের পৃথক সাতটি বাসে তুলে চট্টগ্রামের উদ্দেশে পাঠানো হয়।
বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যেতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদের উখিয়া কলেজ মাঠে জড়ো করা হচ্ছে। বিকেল পর্যন্ত আরও একাধিক দফায় কয়েক শ রোহিঙ্গা ভাসানচরে স্থানান্তর করা হতে পারে। চট্টগ্রাম থেকে নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে জাহাজে করে এসব রোহিঙ্গা পরিবারকে নেওয়া হবে ভাসানচর আশ্রয়শিবিরে।
জাতিসংঘ যুক্ত হওয়ার পর এটাই ভাসানচরে প্রথম দফায় রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর কার্যক্রম। এর আগে ছয় দফায় কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে ভাসানচর আশ্রয়শিবিরে স্থানান্তর করা হয়েছিল ১৮ হাজার ৫০০ রোহিঙ্গাকে। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয়সহ জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, এনজিও সংস্থা রোহিঙ্গা স্থানান্তর কার্যক্রমে যুক্ত রয়েছে।
অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ শামছু-দ্দৌজা বলেন, আজ সকালে সপ্তম দফার প্রথম ধাপে কক্সবাজার থেকে সাতটি বাসে কিছু রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তরের উদ্দেশে চট্টগ্রাম পাঠানো হয়েছে। আরও কিছু রোহিঙ্গা পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে। কিন্তু কতজন যাচ্ছে—তা এ মুহূর্তে নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। এর আগে ছয় দফায় রোহিঙ্গা স্থানান্তর হয়েছিল ১৮ হাজার ৫০০ জন।
তরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত সরকারি সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলেন, ৭টি বাসে প্রথম ধাপে ১২৬টি পরিবারের ২৫৭ জন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ শিশুকে চট্টগ্রামে পাঠানো হয়েছে। রোহিঙ্গারা সবাই উখিয়ার কুতুপালং, লম্বাশিয়া ও বালুখালী ক্যাম্পের ছিল। এর আগে রোহিঙ্গাদের উখিয়া ডিগ্রি কলেজ মাঠের অস্থায়ী কেন্দ্রে রাখা হয়।
উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্প-২ ইস্ট থেকে দুই সদস্যের পরিবার নিয়ে একটি বাসে ওঠেন রোহিঙ্গা মো. রফিক (৩০)। গতকাল মঙ্গলবার রাতেই এই পরিবারকে ক্যাম্প থেকে উখিয়া কলেজ মাঠে আনা হয়। বাসে ওঠার আগে মো. রফিক বলেন, ‘ভাসানচরের আশ্রয়শিবির কক্সবাজারের ক্যাম্পের তুলনায় অনেক উন্নত, থাকার পরিবেশও ভালো। তাই স্বেচ্ছায় সেখানে চলে যাচ্ছি। যখন মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার (প্রত্যাবাসন) পরিস্থিতি হবে তখন ভাসানচর থেকে চলে আসব। কারণ, আমরা মিয়ানমারে ফিরতে চাই।’
তিন সদস্যের পরিবার নিয়ে আরেকটি বাসে ওঠেন একই ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নুর আলম (৪৬)। তিনি বলেন, উখিয়া ও টেকনাফের ছয় হাজার একরের পাহাড় ভূমিতে গড়ে উঠেছে সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গার বসতি। উখিয়ার ঘনবসতির কয়েকটি ক্যাম্পের ঝুঁকি কমাতে এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচর আশ্রয়শিবিরে স্থানান্তরের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। জাতিসংঘও শরণার্থীদের নিরাপত্তা ও দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছে। ভাসানচর আশ্রয়শিবির কক্সবাজার ক্যাম্পের তুলনায় অনেক নিরাপদ, ঝুঁকিমুক্ত, সুযোগ-সুবিধাও বেশি। সবদিক বিবেচনা করে তারা ভাসানচর যাচ্ছে।
তবে বেশির ভাগ পরিবারের সদস্য একজন কিংবা দুজন। অনেককে পরিবারের কিছু সদস্য কক্সবাজারে রেখে ভাসানচর যাচ্ছেন। সেখানকার পরিবেশ ভালো দেখলে পরবর্তী সময়ে রেখে যাওয়া সদস্যদের নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন অনেকে।
আরআরআরসি কার্যালয় সূত্রমতে, দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা ও প্রস্তুতির পর ২০২০ সালের ৪ ডিসেম্বর রোহিঙ্গাদের প্রথম দলটিকে কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে পাঠানো হয়। এর পর থেকে গত ২ এপ্রিল পর্যন্ত মোট ছয় দফায় ১৮ হাজার ৫০০ জনকে ভাসানচরে নেওয়া হয়। কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে নেওয়া পর্যন্ত আরআরআরসির দপ্তর, নৌবাহিনী, এনজিওবিষয়ক ব্যুরো, জেলা প্রশাসন ও এনজিওদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ চলছে। এখন পর্যন্ত ভাসানচরে কাজ করছে ৩০টি এনজিও। প্রতিটি পরিবারের জন্য খাবারসহ সব ধরনের মানবিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
ভাসানচরের আশ্রয়শিবিরে মোট ১ লাখ রোহিঙ্গাকে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা আছে সরকারের। সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ৩ হাজার ৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নোয়াখালীর হাতিয়ার ভাসানচরে এক লাখ রোহিঙ্গার ধারণক্ষমতার আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। ১৩ হাজার একর আয়তনের ওই চরে ১ লাখ রোহিঙ্গা বসবাসের উপযোগী ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করা হয়।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতা শুরু হলে পরের কয়েক মাসে অন্তত ৮ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এর আগে আসে আরও কয়েক লাখ। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১১ লাখ।