কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব, বিপাকে শিক্ষার্থীরা

হাঙর ভাস্কর্য মোড়ের একটি ভবনে কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস
ছবি: প্রথম আলো

২০১৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর উখিয়ায় দলীয় জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজারে উচ্চশিক্ষা বিস্তারে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। এ ঘোষণার মাত্র ১২ দিনের মধ্যে ১৫ সেপ্টেম্বর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (সিবিআইইউ) অনুমোদন মেলে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ব্যবসায়ী সালাহ উদ্দিন আহমদ। এরপর কলাতলী সৈকতসংলগ্ন হাঙর ভাস্কর্য মোড়ের একটি ভবনের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ তলার কিছু অংশ ভাড়া নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী ক্যাম্পাস চালু করা হয়। তবে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সাত বছরেও হয়নি স্থায়ী ক্যাম্পাস, নেই রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগকৃত উপাচার্য।

বছর দুয়েক ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা নিয়ে প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান সালাহ উদ্দিন আহমদের সঙ্গে ট্রাস্টি বোর্ডের সেক্রেটারি লায়ন মুজিবুর রহমানের দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। এ দ্বন্দ্ব মামলা পর্যন্ত গড়িয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে এখনো কোনো সমাধান হয়নি। এতে আট শতাধিক শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন নিয়ে অনিশ্চিয়তা দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধসহ ১ বছরের মধ্যে ১৬টি শর্ত বাস্তবায়নের নির্দেশনা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে চিঠি পাঠিয়েছে ইউজিসি।

ইউজিসির ১৬ শর্ত

গত ১০ সেপ্টেম্বর বেসরকারি বিশ্ববিদালয় বিভাগের পরিচালক মো. ওমর ফারুক স্বাক্ষরিত একটি চিঠি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে পাঠায় ইউজিসি।

সেখানে ১৬টি শর্তের মধ্যে রয়েছে, এক বছরের মধ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের জন্য দুই একর নিষ্কণ্টক জমি ক্রয় ও স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ; এক মাসের মধ্যে রাষ্ট্রপতি ও আচার্য কর্তৃক উপাচার্য ও সহ–উপাচার্য নিয়োগ; তিন মাসের মধ্যে বিগত বছরের সব অডিট সম্পন্ন এবং সংরক্ষিত তহবিলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকাল থেকে অদ্যাবধি হিসাব করে সুদসহ মূল টাকা পুনর্ভরণ করা; প্রতিটি বিভাগে কমপক্ষে একজন পূর্ণকালীন অধ্যাপক বা সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপকসহ কমিশনের শিক্ষক নিয়োগ; গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা; বিনা বেতনে অধ্যয়নের সুযোগ; নিয়মিত সমাবর্তন আয়োজন করা; সিলেবাসগুলো হালনাগাদ; ক্লাসরুম, ল্যাব, সেমিনারকক্ষ ও পাঠাগার আধুনিকায়ন এবং শিক্ষা উপযোগী করতে হবে। অন্যথায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাময়িক সনদের মেয়াদ বাড়ানো যাবে না বলে সতর্ক করা হয়েছে।

একই ভবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন পরিবহনের টিকিট কাউন্টার, দোকানপাট ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অফিস

মালিকানার দ্বন্দ্ব

বিশ্ববিদ্যালয়ের নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০১৩ সালে ১০ সদস্যবিশিষ্ট বোর্ড অব ট্রাস্টিজের অনুমোদন দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শুরু থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার বিষয়টি লায়ন মুজিবের নিয়ন্ত্রণে ছিল। আধিপত্য বিস্তার, ব্যবসায় অনিয়ম-দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে ২০২০ সালে ট্রাস্টির চেয়ারম্যান ও সেক্রেটারির মধ্যে বিভাজন তৈরি হয়। দ্বন্দ্বের জেরে লায়ন মুজিব সালাহ উদ্দিন আহমদকে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে কক্সবাজার-১ আসনের আওয়ামী লীগ সাংসদ জাফর আলমকে নিযুক্ত করেন।

আবার সালাহ উদ্দিন আহমদ লায়ন মুজিবকে সেক্রেটারি পদ থেকে সরিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমানকে সেক্রেটারি পদে বসান।
জানতে চাইলে সালাহ উদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে সাবেক সেক্রেটারি লায়ন মুজিব ২ কোটি ১৯ লাখ টাকা সরিয়ে নিয়েছিলেন। এত দিন লায়ন মুজিব নিয়ম মেনে বিশ্ববিদ্যালয় চালাননি। এ কারণে ভুগতে হচ্ছে। তবে অক্টোবর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হচ্ছে। ইউজিসির ১৬ নির্দেশনা অনুযায়ী ইতিমধ্যে উপাচার্য নিয়োগের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য রামুর দুটি এলাকায় জমি দেখা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে কিছুদিন আগে এক কোটি টাকা জমা করা হয়েছে, আরও টাকা জমা করা হবে।

তবে অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে লায়ন মুজিবুর রহমান বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টি সুচারুভাবে পরিচালনা করে আসছিলেন। কিন্তু সালাহ উদ্দিন আহমদ অসৎ উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়টি দখল করলে সংকট দেখা দেয়। হাজারো শিক্ষার্থীর জীবন নিয়ে তিনি (সালাহ উদ্দিন) ছিনিমিনি খেলছেন। সালাহ উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন ট্রাস্টি কমিটিকে তিনি অবৈধ বলেও দাবি করেন।

উপাচার্য নিয়োগ, স্থায়ী ক্যাম্পাসসহ ২০ দফা দাবিতে শিক্ষার্থীরা সম্প্রতি মানববন্ধন করেছেন

বিপাকে শিক্ষার্থীরা

১৪ তলার একটি বাণিজ্যিক ভবনের ৩টি তলা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। ওই ভবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন পরিবহনের টিকিট কাউন্টার, দোকানপাট ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অফিস। বাস কাউন্টারের সামনে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বাসে যাত্রীদের ওঠানামা চলে। টিকিট কাউন্টারের পাশ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার পথ। বাসের যাত্রী আর মূল সড়কের কোলাহলে সেখানে পড়াশোনা করার মতো কোনো পরিবেশ নেই। চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ায় ইতিমধ্যে ভবনের তৃতীয় ও চতুর্থ তলা ছেড়ে দিতে হয়েছে। এখন দ্বিতীয় তলার মাত্র কয়েকটি কক্ষ নিয়ে চলছে বিশ্ববিদ্যালয়টি।

বিদ্যুৎ বিল বকেয়া থাকায় ২০২০ সালের জানুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যুৎ–সংযোগও বিচ্ছিন্ন করা হয়। এর পর থেকে পাঠদানও বন্ধ হয়ে যায়। মার্চের মাঝামাঝি সময়ে করোনার প্রকোপে দেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো এই বিশ্ববিদ্যালয়ও বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় দেড় বছর বন্ধ থাকার পর দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পুরোদমে খোলার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। কিন্তু সিবিআইইউ কী করবে, তা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উদ্বিগ্ন।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত সিবিআইইউতে অন্তত ২ হাজার ৫০০ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১ হাজার ৭০০ শিক্ষার্থী ইতিমধ্যে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে আইন, ইংরেজি, বিবিএ, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, হসপিটালিটি অ্যান্ড ট্যুরিজম ম্যানেজমেন্ট (এইচটিএম), লাইব্রেরি অ্যান্ড ইনফরমেশন সায়েন্স ও ইসলামিক স্টাডিজ অনুষদে আট শতাধিক শিক্ষার্থী আছেন। মালিকানা দ্বন্দ্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অচলাবস্থায় শিক্ষার্থীরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।

অবিলম্বে ইউজিসির শর্তগুলো বাস্তবায়নের দাবিতে সিবিআইইউর বর্তমান শিক্ষার্থীরা অন্দোলনে নেমেছেন। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মোর্চা স্টুডেন্ট ফোরামের মুখপাত্র হোসাইন মুরাদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস, উপাচার্য কিছুই নেই। শুধু একটা নাম আছে। এখান থেকে পাস করে বের হওয়া শিক্ষার্থীরা অস্থায়ী প্রত্যয়নপত্রও পাচ্ছেন না। ফলে তাঁরা উচ্চশিক্ষা কিংবা চাকরির সুযোগ না পেয়ে এখন পথে পথে ঘুরছেন।