বৈরী পরিবেশে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার এখন উত্তাল। চলছে ৩ নম্বর সতর্কসংকেত। তিন দিন ধরে চলছে টানা ভারী বর্ষণ। করোনা পরিস্থিতির কারণে তিন মাস ধরে সৈকতে পর্যটকের যাতায়াতও নিষিদ্ধ। এ কারণে ফাঁকা পড়ে আছে পুরো সৈকত।
এমন পরিবেশে আগামী শনিবার থেকে চালু হচ্ছে কোভিড–১৯ রোগীদের বিনা মূল্যে থাকা-খাওয়া ও চিকিৎসার জন্য ২০০ বেডের আইসোলেশন সেন্টার। সেন্টারটি হচ্ছে ১১ তলাবিশিষ্ট একটি তারকা হোটেল ‘সি-প্রিন্সেস’ এ। হোটেলটির অবস্থান সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে। যেখান থেকে সমুদ্রের দূরত্ব মাত্র সাত শ ফুট।
হোটেলটির সব কক্ষ থেকে দেখা যায় পশ্চিম দিকে সমুদ্র এবং পূর্ব দিকের উঁচু পাহাড়ের সারি। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ, নির্মল হাওয়ার সঙ্গে সবুজের সমারোহের মধ্যে করোনা রোগীরা এখানে অবস্থান করবেন।
করোনা চিকিৎসার অন্যতম উপদান হলো নির্মল বাতাস। ফুসফুসে আঘাত হানা ভাইরাস করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করতে আইসোলেশন কক্ষটি জানালার পাশে রাখার নির্দেশনা আছে। সেটি মাথায় রেখে সমূদ্রের তীরের নির্মল পরিবেশে আইসোলেশন সেন্টারটি গড়ে তোলা হয়েছে, জানালেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আশরাফুল আফসার।
করোনা রোগীদের জন্য এ রকম মনোরম পরিবেশ চিহ্নিত করেন জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন। রোহিঙ্গা শিবিরে শরণার্থীদের মানবিক সেবায় নিয়োজিত জাতিসংঘের একাধিক দাতা সংস্থা, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাসহ জেলা প্রশাসনের সহায়তায় ২০০ বেডের এই আইসোলেশন সেন্টার গড়ে তোলা হচ্ছে।
জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘অদৃশ্য করোনাভাইরাস নিয়ে সবাই আতঙ্কে আছি। সংক্রমণও দিন দিন বাড়ছে। হাসপাতাল-আইসোলেশন সেন্টারে গাদাগাদি অবস্থা, জায়গার সংকট। বহু করোনা রোগীর ঘরে থাকার জায়গা নেই। থাকলেও আলাদাভাবে থাকার পরিবেশ নেই। সবদিক বিবেচনা করে সৈকত তীরের নির্মল পরিবেশে তারকা হোটেলটি আইসোলেশনের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে। আশা করছি রোগীরা চিকিৎসার পাশাপাশি মন ভরে শ্বাস নিতে পারবেন। শনিবার সকাল থেকে সেন্টারটি চালু হচ্ছে। করোনা রোগীরা বিনা ভাড়ায় হোটেলে থাকার সুযোগ পাচ্ছেন। তবে অসচ্ছল রোগীদের জন্য বিনা মূল্যে খাবারের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।’
রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে চিকিৎসক, নার্স ও কর্মী জোগান দিচ্ছে জেলা সিভিল সার্জন অফিস। রোগীদের ওষুধ, খাবার, বেতন–ভাতাসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় বহন করছে জাতিসংঘের একাধিক সংস্থাসহ বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। জেলা প্রশাসন ও সিভিল সার্জন অফিস সমন্বিতভাবে আইসোলেশন সেন্টারের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
সিভিল সার্জন মাহবুবুর রহমান বলেন, তুলনামূলকভাবে যেসব করোনা রোগীর উপসর্গ নেই, যাঁরা মোটামুটি সুস্থ, তাঁদের এই আইসোলেশন সেন্টারে রাখা হবে। আর যেসব রোগীর বাড়িতে আলাদা থাকার জায়গা বা ব্যবস্থা নেই বা সংক্রমণ ঝুঁকির কারণে বাড়িতে থাকতে চান না, তাঁদেরও এই হোটেলে রাখা হবে।
বেড়েই চলেছে করোনার সংক্রমণ
কক্সবাজারের আটটি উপজেলায় করোনার সংক্রমণ বেড়ে চলছে। ১৭ জুন পর্যন্ত করোনা শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ৭৬৮ জনের। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৮২৩ জন, চকরিয়ায় ২৬৯, উখিয়ায় ২৫২, টেকনাফে ১৪৮, রামুতে ১২৩, পেকুয়ায় ৭৯, মহেশখালীতে ৬৪ ও কুতুবদিয়ায় ১০ জন। জেলায় এ পর্যন্ত মারা গেছেন ২৮ জন। সুস্থ হয়েছেন ৪৪৯ জন। কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ ল্যাবে এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ১৩ হাজার ১০৮ জনের।
৬ জুন থেকে কক্সবাজার পৌরসভাসহ বিভিন্ন উপজেলায় রেড জোন ঘোষণা করে কঠোর লকডাউন পালিত হচ্ছে।
কোভিডের রোগীদের শয্যার সংকট
রামু ও চকরিয়া উপজেলায় রয়েছে ৫০ শয্যার পৃথক দুটি (মোট ১০০ শয্যা) আইসোলেশন সেন্টার। উখিয়ায় সম্প্রতি বেসরকারি সহযোগিতায় তৈরি হয়েছে ১৪০ শয্যার কোভিড-১৯ হাসপাতাল। আটটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রয়েছে রোগীর আরও কিছু শয্যা।
সিভিল সার্জন মাহবুবুর রহমান বলেন, সংক্রমণ যে হারে বাড়ছে, সে তুলনায় আইসোলেশন শয্যার সংকট আছে। বর্তমানে অন্তত ৩২০ শয্যা প্রস্তুত আছে। আরও পাঁচ শতাধিক রোগীকে বাড়িতে রেখে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে।
জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, সংকট নিরসনে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে আগামী শনিবার থেকে চালু হচ্ছে সৈকতের ২০০ বেডের আইসোলেশন সেন্টার। পাশাপাশি রামু ও চকরিয়ায় ৫০ শয্যার আইসোলেশন সেন্টারে অতিরিক্ত আরও ২৫ বেড করে ৫০ শয্যা বাড়ানো হচ্ছে। চকরিয়া মেমোরিয়াল খ্রিষ্টান হাসপাতালে করোনা চিকিৎসার জন্য ১৫ শয্যার পৃথক আইসোলেশন সেন্টারের প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে।
এ ছাড়া ২৫০ শয্যার কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নির্মাণাধীন ১০ শয্যার আইসিইউ ইউনিটের পাশাপাশি সাধারণ রোগীদের সুরক্ষায় একই ভবনে ৫০ বেডের পৃথক আইসোলেশন ইউনিট তৈরির কাজ চলছে। এর বাইরে কক্সবাজার স্টেডিয়ামে ২০০ শয্যার আরেকটি ফিল্ড হাসপাতাল নির্মাণের প্রস্তুতি চলছে। সব হাসপাতাল জাতিসংঘরের বিভিন্ন দাতা সংস্থা এবং বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার অর্থায়নে গড়ে তোলা হচ্ছে।