চিংড়ি পোনার উৎপাদন বাড়াতে ব্যবহৃত হচ্ছে দেশে উদ্ভাবিত ‘জীবন্ত খাবার’ বা ‘লাইভফিড’। টানা কয়েক বছর গবেষণার পর সম্প্রতি বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জাকিয়া হাসানের নেতৃত্বে গবেষক দল উপকূল থেকে লাইভফিড উদ্ভাবনের কথা জানায়। ইতিমধ্যে কক্সবাজারের বিভিন্ন হ্যাচারিতে লাইভফিডের ব্যবহার শুরু হয়েছে। এর আগে বিদেশ থেকে পোনার খাবার আমদানি করতে হতো। এতে একদিকে পোনার উৎপাদন ব্যয় বাড়ত, অন্যদিকে খাবারের গুণগত মান নষ্ট হওয়াসহ বিভিন্ন সময় হ্যাচারিতে পোনা মারা যেত। ফলে ‘লাইভফিড’ উদ্ভাবনের কারণে চিংড়ি ও কাঁকড়ার উৎপাদন দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপকূলের ৫০টি হ্যাচারিতে প্রতিবছর ৬৫০ কোটি চিংড়ির পোনা উৎপাদিত হয়। এসব পোনা যায় খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটসহ দেশের বিভিন্ন উপকূলীয় জেলায়। হ্যাচারিতে উৎপাদিত পোনা দিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকার ২ লাখ ৭৫ হাজার হেক্টর জমিতে (ঘেরে) বাগদা চিংড়ির চাষ হচ্ছে। এসব চিংড়ি বিদেশে রপ্তানি করে অর্জিত হচ্ছে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি বৈদেশিক মুদ্রা।
জলজ পরিবেশে সবুজ রঙের যেসব ক্ষুদ্র কণা দেখা যায়, তাই লাইভফিড বা ফাইটোপ্লাঙ্কটন। এটি এককোষী অতি আণুবীক্ষণিক কণা (খালি চোখে দেখা যায় না), যা সূর্যালোকের উপস্থিতিতে পানিতে বিদ্যমান কার্বন ডাই–অক্সাইড ব্যবহার করে নিজেদের জন্য শক্তি উৎপাদন করে এবং উপজাত হিসেবে অক্সিজেন উৎপন্ন করে।
হ্যাচারির মালিকদের সংগঠন শ্রিম্প হ্যাচারি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (সেব) সভাপতি ও কক্সবাজার-২ আসনের সাংসদ আশেক উল্লাহ রফিক প্রথম আলোকে বলেন, চিংড়ি পোনার পরিপূরক খাদ্য হিসেবে লাইভফিড এত দিন ভারত, থাইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করতে হতো। এতে খরচ হতো লাখ লাখ টাকা। তবে কক্সবাজার উপকূল থেকে ‘লাইভফিড’ উদ্ভাবন করা হয়েছে। লাইভফিডগুলো হ্যাচারিতে বিনা মূল্যে সরবরাহ করা হচ্ছে। ফলে চিংড়ির উৎপাদন বাড়বে দ্বিগুণ এবং গুণগত মানসম্পন্ন চিংড়ি রপ্তানি হলে বৈদেশিক মুদ্রার অর্জনও বেড়ে যাবে। আমাদের লক্ষ্য, আগামী তিন বছরে চিংড়ি রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা ৫ হাজার কোটি থেকে ১০ হাজার কোটিতে নিয়ে যাওয়া। এ লক্ষ্যে চাষিদের প্রশিক্ষণ ও সনাতন পদ্ধতির ঘেরগুলো আধুনিক পর্যায়ে উন্নয়নের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
মৎস্যবিজ্ঞানীরা বলেন, জলজ পরিবেশে সবুজ রঙের যেসব ক্ষুদ্র কণা দেখা যায়, তাই লাইভফিড বা ফাইটোপ্লাঙ্কটন। এটি এককোষী অতি আণুবীক্ষণিক কণা (খালি চোখে দেখা যায় না), যা সূর্যালোকের উপস্থিতিতে পানিতে বিদ্যমান কার্বন ডাই–অক্সাইড ব্যবহার করে নিজেদের জন্য শক্তি উৎপাদন করে এবং উপজাত হিসেবে অক্সিজেন উৎপন্ন করে। মৎস্যবিজ্ঞানীদের মতে, প্রকৃতিতে প্রায় এক লাখ প্রজাতির মাইক্রোএলজি বিদ্যমান এবং পৃথিবীর প্রায় ৭০ ভাগের বেশি অক্সিজেন এটা থেকে উৎপন্ন হয়। অক্সিজেনের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি সামুদ্রিক মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া ও ঝিনুকের খাবার হিসেবে মাইক্রোএলজির ভূমিকা অপরিসীম। পুষ্টিগুণ বিচারে মাইক্রোএলজি উদ্ভিদ আমিষের আদর্শ উৎস; যা ভবিষ্যৎ ‘সুপারফুড’ নামে বিবেচিত হবে।
প্রজাতিভেদে প্রতি ৫-১০ মিলিলিটার লাইভফিড আমদানিতে খরচ হতো ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। এখন বিনা মূল্যে হাচারিমালিকেরা পোনার খাদ্য হিসেবে লাইভফিড ব্যবহার করছেন। এ জন্য পোনার উৎপাদন খরচ ও মৃত্যুঝুঁকি কমেছে।জাকিয়া হাসান, জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট
গবেষণা দলের প্রধান জাকিয়া হাসান প্রথম আলোকে বলেন, সামুদ্রিক মাছের মতো চিংড়ি, কাঁকড়া, লবস্টার ও অন্যান্য জলজ প্রাণী ডিম থেকে পরিস্ফুটনের পর প্রাথমিক খাবার হিসেবে মাইক্রোএলজি (লাইভফিড) গ্রহণ করে। এ ছাড়া ঝিনুক তাদের জীবনে পুরো সময় পানি ছাঁকানোর মাধ্যমে লাইভফিড গ্রহণ করে; যা তাদের দৈহিক বৃদ্ধি ও গোনাডের (ডিম) পরিপক্বতা পেতে সাহায্য করে। আগে প্রজাতিভেদে প্রতি ৫-১০ মিলিলিটার লাইভফিড আমদানিতে খরচ হতো ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। এখন বিনা মূল্যে হাচারিমালিকেরা পোনার খাদ্য হিসেবে লাইভফিড ব্যবহার করছেন। এ জন্য পোনার উৎপাদন খরচ ও মৃত্যুঝুঁকি কমেছে।
বিএফআরআইয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শফিকুর রহমান বলেন, দেশে মাছ চাষ বাড়লেও সমুদ্রের ক্ষেত্রে এখনো আহরণনির্ভর। লাভজনক ভিত্তিতে সামুদ্রিক মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া ও ঝিনুক চাষ করতে হলে সহজলভ্য পোনা যেমন প্রয়োজন, তেমন পোনার জন্য অধিক পুষ্টিগুণসম্মৃদ্ধ খাবার প্রয়োজন। মিঠাপানির মাছ খুব সহজে কৃত্রিমভাবে প্রস্তুতকৃত খাবারে অভ্যস্ত হতে পারে কিন্তু সামুদ্রিক ও অন্যান্য জলজ প্রাণীদের ক্ষেত্রে তা হয় না। সমুদ্রের প্রাণীদের পরিপূরক খাদ্য হিসেবে লাইভফিড গ্রহণ করতে হয়।
গবেষক দল সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার উপকূল থেকে নমুনা সংগ্রহ করে প্রজাতি পৃথককরণের মাধ্যমে চিংড়ির লার্ভা চাষে ব্যবহৃত অধিক পুষ্টিগুণসম্পন্ন মাইক্রোএলজি (লাইভফিড) উদ্ভাবন করা হয়। চিংড়ির পোনা ছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা, কাঁকড়ার খাদ্য হিসেবে এই লাইভফিড বেশি কার্যকর। কক্সবাজারের হ্যাচারিগুলোতে ইতিমধ্যে লাইভফিডের ব্যবহার শুরু হয়েছে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও গবেষণার জন্য কক্সবাজার থেকে মাইক্রোএলজির বিভিন্ন জাত সংগ্রহ করছে।
মৎস্যবিজ্ঞানীরা বলেন, মাইক্রোএলজি নিজেদের খাবার নিজেরা তৈরি করতে পারে বিধায় তাদের প্রোডিউসার বা উৎপাদক বলা হয়। মাছ জীবনচক্রের শুরুতে ডিম থেকে ফোটার পর প্রাকৃতিকভাবে পেটে কুসুম বহন করে; যা প্রজাতিভেদে এক থেকে সাত দিনের মধ্যে শোষিত হয় এবং পরবর্তী সময়ে মাছের পোনাকে অবশ্যই প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত খাদ্যকণার ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। মাছের পোনার মুখের আকার ও পুষ্টি চাহিদার ওপর ভিত্তি করেই মাইক্রোএলজি গ্রহণ করে।
সেবের মহাসচিব নজিবুল ইসলাম বলেন, দেশে আগে চিংড়ি চাষ হতো উপকূল থেকে মশারি জাল দিয়ে আহরিত পোনা দিয়ে। এখন ঘেরগুলো হ্যাচারিতে উৎপাদিত পোনার ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৫০টি হ্যাচারিতে বছরে ৬৫০ কোটি পোনা উৎপাদিত হচ্ছে। পোনা উৎপাদনের জন্য গভীর সমুদ্র থেকে আহরণ করা হচ্ছে মা চিংড়ি। হ্যাচারিতে উৎপাদিত পোনার খাবার হিসেবে লাইভফিডের বিকল্প নেই। আমদানি করা লাইভফিড হিমায়িত করে রাখায় তার গুণগত মান কমে যেত। দেশে উৎপাদিত লাইভফিডে এ ঝুঁকি নেই। লাইভফিড উৎপাদনের ফলে হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদনের খরচ ও ভোগান্তি কমছে। পোনার গুণগত মান রক্ষা পাওয়ায় দেশব্যাপী চিংড়ির উৎপাদন বাড়লে অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধ হবে বলে মনে করেন তিনি।