সিলেটের বন্দরবাজার ফাঁড়িতে মো. রায়হান আহমদকে ধরে এনে নির্যাতনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী দুই পুলিশ সদস্যকে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বলেছিলেন বরখাস্ত হওয়া এসআই আকবর হোসেন ভূঞা। সত্য কথা বললে ‘বুকে গুলি করব, পিঠ দিয়ে বের হবে’ বলে হুমকি দিয়েছিলেন তিনি।
ঘটনার দিন (১০ অক্টোবর) মধ্যরাত থেকে পরদিন ভোর পর্যন্ত ফাঁড়িতে সেন্ট্রি পোস্টে কর্তব্যরত তিনজন কনস্টেবল শামীম মিয়া, সাইদুর রহমান ও দেলোয়ার হোসেন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। এর মধ্যে সাইদুর ও দেলোয়ারকে আকবর মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বলেছিলেন বলে তাঁরা জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন।
মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশের ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সূত্র জানায়, তিন কনস্টেবলের জবানবন্দির পরদিনই বরখাস্ত কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাসকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। টিটুর রিমান্ড শেষে তিন প্রত্যক্ষদর্শী কনস্টেবলের জবানবন্দিতে পাওয়া তথ্যের সূত্র ধরে তদন্ত চলছে।
সিলেট মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত উপকমিশনার বি এম আশরাফ উল্যাহ জানিয়েছেন, বরখাস্ত আকবর ছাড়া ছয়জনকে মহানগর পুলিশ লাইনসে নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। নির্যাতনের প্রত্যক্ষদর্শী তিন কনস্টেবল সম্পর্কে তিনি বলেন, এ তিনজন বর্তমানে ফাঁড়িতেই কর্তব্যরত আছেন। ১৯ অক্টোবর সিলেটের অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তাঁরা রায়হানকে নির্যাতন করার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন। ঘটনার রাতে তিনজন ফাঁড়ির সেন্ট্রি পোস্টে কর্তব্যরত ছিলেন।
পুলিশ সূত্র জানায়, ১০ অক্টোবর বন্দরবাজার ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে নির্যাতন করা হয় রায়হানকে। ঘটনা আড়াল করতে ফাঁড়ির ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার চিত্র গায়েব করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে। তবে ফাঁড়ির পাশে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে সিসি ক্যামেরার চিত্রে রায়হানকে ফাঁড়িতে নিয়ে আসা ও ভোরবেলা হাসপাতালে ভর্তি করতে নিয়ে যাওয়ার চিত্র ধরা পড়ে। এই চিত্র নিয়ে নগর পুলিশের একটি অনুসন্ধান কমিটি তদন্ত করে ফাঁড়ির ইনচার্জ আকবরসহ নির্যাতনে সাত পুলিশ জড়িত থাকার প্রমাণ পায়। ১২ অক্টোবর আকবরসহ চারজনকে বরখাস্ত ও তিনজনকে প্রত্যাহার করা হয়। বরখাস্ত হওয়ার পর থেকে আকবরকে পাওয়া যাচ্ছে না। বাকি তিনজন বরখাস্তের মধ্যে কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাসকে ২০ অক্টোবর গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পিবিআই। ২১ অক্টোবর ফাঁড়ির সিসি ক্যামেরার চিত্র নষ্ট করা ও আকবরকে পালাতে সহায়তা করার দায়ে ‘টুইআইসি’ পদে থাকা এসআই হাসান উদ্দিনকে বরখাস্ত করা হয়।
১০ অক্টোবর রাতে ডিউটি না থাকায় ফাঁড়ির কক্ষে ঘুমিয়েছিলেন কনস্টেবল শামীম মিয়া। রাত আনুমানিক তিনটায় কান্নার আওয়াজ শুনে তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। শামীম জবানবন্দিতে বলেন, ‘ঘুম ভেঙে দেখি, একজন লোক দুই হাত পেছন দিক করে হাতকড়া লাগানো, মেঝেতে বসে চিৎকার করছে। তখন বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাস তাঁর হাতে থাকা মোটা লাঠি দিয়ে লোকটিকে হাতে, পায়ে ও কোমরে এলোপাতাড়িভাবে মারপিট করছেন এবং বলছেন, “গ্রেপ্তারের সময় কেন এত শক্তি দেখালি? কেন এত ধস্তাধস্তি করলি?”’
শামীমের জবানবন্দি অনুযায়ী, টিটুর মারপিটে লোকটি ডান দিকে কাত হয়ে শুয়ে পড়ে। তখন টিটু লোকটির পায়ের তলায় আঘাত করে। এরপর কনস্টেবল হারুন অর রশিদ রুমে প্রবেশ করে লোকটিকে মারধর করতে থাকে। তখন কনস্টেবল টিটু, এএসআই আশেক এলাহি, এএসআই কুতুব আলী উপস্থিত ছিলেন। রুমের দরজার কাছে কনস্টেবল সজীব ও তৌহিদ দাঁড়ানো অবস্থায় ছিলেন। কিছুক্ষণ পর পুলিশ ফাঁড়ির আইসি আকবর হোসেন ভূঞা রুমে প্রবেশ করেন। তিনি টিটুর হাতে থাকা লাঠি নিয়ে লোকটির নাম ও ঠিকানা জিজ্ঞেস করেই বেধড়ক মারপিট করতে থাকেন। আকবরের মারমুখী আচরণ দেখে এএসআই কুতুব আকবরের হাত ধরে বলেন, ‘স্যার এভাবে আর মাইরেন না।’ আকবর তখন লাঠি হাতে রুমের বিছানায় বসে পড়েন।
এ সময় রুমে একটি লোক প্রবেশ করেন। তিনি আকবরকে বলেন, রায়হান তাঁর মুঠোফোন ও টাকা চুরি করেছেন। তখন রায়হান বলেন, ‘স্যার, আমি টাকা নিই নাই। শুধু মোবাইল ফোনটি নিয়েছিলাম, ফোনটি ফেরত দিয়েছি। টাকা অন্য দুজন ছিনতাইকারী নিয়েছে।’ তখন অজ্ঞাত লোকটি বলেন যে ‘না, এই লোকটিই (রায়হান) আমার টাকা ও মোবাইল ফোন নিয়েছে।’ আকবর তখন অজ্ঞাত লোকটিকে ফাঁড়ির বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে রায়হানকে আবার মারতে থাকেন।
এরপরও মারধর চলতে থাকলে কক্ষে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন শামীম। সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে ঘুম থেকে উঠে ডিউটির জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার সময় তিনি দেখেন, যে স্থানটিতে রাতে রায়হানকে মারধর করা হয়েছিল, সেই স্থানটি পানিতে ভেজা। এরপর কর্মকর্তাদের নির্দেশে তিনি ওসমানী মেডিকেল কলেজে গিয়ে হৃদ্রোগ বিভাগের সামনে রায়হানের লাশ দেখতে পান। এ সময় লাশের এক পাশে এএসআই তৌহিদ দাঁড়ানো ছিলেন। কিছুক্ষণ পর লাশটি হিমঘরে নেওয়া হয়।
ঘটনার দিন রাত ১২টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত ফাঁড়ির সেন্ট্রি ডিউটিতে ছিলেন সাইদুর রহমান। জবানবন্দিতে তিনি বলেছেন, রায়হানকে থানায় ধরে নিয়ে আসা এবং নির্যাতনের ঘটনা তিনি দেখেছেন। ফাঁড়ির সেন্ট্রি পোস্ট থেকে তিনি রায়হানের চিৎকার শুনতে পেয়ে রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখেন, কনস্টেবল হারুন রায়হানের দুই পা উঁচু করে ধরে রেখেছেন, আকবর ও টিটু লাঠি দিয়ে লোকটির পায়ের পাতায় আঘাত করছেন। তিনি মারধরের কারণ জানতে চাইলে এসআই আকবর বলেন, ‘সে একজন ছিনতাইকারী। সঙ্গে থাকা দুজনের নাম জানতে জিজ্ঞাসাবাদ করছি।’ এ সময় পাশ থেকে এএসআই আশেক এলাহি বলেন, ‘সে পুলিশের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছে। পায়ে মারেন, পায়ে মারেন...সমস্যা নাই।’ এ অবস্থায় আকবর সাইদুরকে ধমক দিয়ে সেন্ট্রি পোস্টে ডিউটিতে যেতে বলেন। এরপর তিনি ডিউটিরত অবস্থায় বেশ কয়েকবার রায়হানের চিৎকার শোনেন।
জবানবন্দিতে সাইদুর বলেছেন, ‘পরদিন দুপুর সাড়ে ১২টায় ফাঁড়িতে ডিসি (উপকমিশনার) স্যার আসবেন বলে আমাকে আসতে বলা হয়। আকবর স্যার তখন আমাকে বলেন, “ডিসি স্যার জানতে চাইলে বলবা রাতে ফাঁড়িতে কোনো লোক এনে নির্যাতন করা হয় নাই। সে (রায়হান) কাস্টঘর থেকে গণপিটুনি খেয়ে ধরা পড়েছে, তাঁকে (রায়হান) সরাসরি হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।” এই কথা বলে আকবর স্যার হুমকি দেন। আকবর স্যার বলেন, “আমি যা বলব, তাই বলবে। সত্য কথা বললে বুকে গুলি করব, পিঠ দিয়ে বের হবে।” এই হুমকি দিয়ে আকবর স্যার আমার বুকে হাত বুলান।’
১১ অক্টোবর ভোর ৪টার সময় কনস্টেবল সাইদুরের কাছ থেকে সেন্ট্রি পোস্টের ডিউটি বুঝে নেন দেলোয়ার হোসেন। তখন সাইদুর তাঁকে জানান ছিনতাইকারী একজন ধরে এনে মারধর করা হয়েছে। এ সময় এসআই আকবর ও অন্যদের সঙ্গে ছিনতাইয়ের শিকার হওয়া লোকটিও ছিলেন। ঘটনাটি ফাঁড়ির মুন্সির কার্যালয়ের কক্ষে হয়।
দেলোয়ার হোসেন মুন্সির কক্ষের দরজার কাছে গিয়ে দেখেন, এসআই আকবরের হাতে একটি মোটা লাঠি। তিনি চেয়ারে বসা। তাঁর পায়ের কাছে হাতকড়া পরা এক লোক। সেখানে পুলিশের সঙ্গে অজ্ঞাত একজন লোক ও তাঁর সঙ্গে আরও একজন লোককে দেখতে পান। দেলোয়ারকে দেখে আকবর বলেন, ‘তুমি সামনে চলে যাও।’ তখন তিনি সেন্ট্রি পোস্টে ডিউটিতে যান।
ঘটনার বর্ণনায় দেলোয়ার বলেন, এরপর কনস্টেবল তৌহিদ তাঁর কাছে আসেন। আকবর তখন তৌহিদকে ডেকে ভেতরে নিয়ে যান। আকবর তৌহিদের মুঠোফোন থেকে গ্রেপ্তার হওয়া লোকটির (রায়হান) বাড়িতে ফোন দিয়ে ১০ হাজার টাকা নিয়ে আসতে বলেন। তৌহিদ ফোন দেওয়ার পর দেলোয়ার তাঁর কাছে জানতে চান, টাকা কেন নিয়ে আসতে বলেছেন? তখন তৌহিদ বলেন, ‘আকবর স্যার বলেছেন, ছিনতাইয়ের টাকা উদ্ধার দেখাতে ফোন দেওয়া হয়।’ এরপর আকবর এএসআই আশেক এলাহিকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আমি ঘুমিয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ পর তাঁকে (রায়হান) হাসপাতালে নিয়ে যেও।’ ভোর পাঁচটার দিকে আশেক এলাহি ও কনস্টেবল হারুন লোকটিকে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে হাসপাতালে রওনা করার প্রস্তুতি নেন। তাঁরা রওনা দেওয়ার পর আকবরও তাড়াতাড়ি ফাঁড়ি থেকে বের হয়ে যান। এরপর দেলোয়ারের ডিউটি শেষ হলে কনস্টেবল ইলিয়াছকে ডিউটি বুঝিয়ে দিয়ে ঘুমাতে চলে যান।
দেলোয়ার জবানবন্দিতে বলেন, ‘আমি দুপুর ১২টায় ঘুম থেকে উঠে শুনি লোকটি (রায়হান) মারা গেছেন। তখন ফাঁড়িতে ফিরে এসে আকবর স্যার আমাকে বলেন, “ফাঁড়িতে কোনো টর্চারিংয়ের ঘটনা ঘটে নাই। ওই লোক (রায়হান) কাস্টঘর এলাকায় গণধোলাইয়ে মারা গেছে।” এ কথা বলে আকবর স্যার আমাকে হুমকি দিয়ে বলেন, “যদি এই কথা না বলিস, তাহলে বুকে গুলি করব, পিঠ দিয়ে বের হবে।”’
আদালতে দেওয়া জবানবন্দির বর্ণনা শুনে সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আকবর হুমকি দিয়েছিলেন বলে যে বিষয়টি বর্ণনায় এসেছে, এর সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। তদন্তকারী সংস্থাকে এঁদেরকেও নির্যাতনের সহযোগিতাকারী হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। তাঁরা বলেছেন, আকবর হুমকি দিয়েছেন মিথ্যা বলতে। এই হুমকির কথা বলে তাঁরা নিজেদের অপরাধ আড়াল করতে চেয়েছেন। এ ছাড়া নির্যাতন করার সময় যে দুই লোক (ছিনতাইয়ের শিকার ও ড্রাইভার) নাম এসেছে, এঁদেরকেও চিহ্নিত করা দরকার। এঁরাও নির্যাতনেরও সহযোগী।
জানতে চাইলে পিবিআই পরিদর্শক ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মহিদুল ইসলাম তদন্তের স্বার্থে বিস্তারিত কিছু বলতে রাজি হননি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিন প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দির নির্যাতনকারী চিহ্নিত হওয়ায় বরখাস্ত কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাসকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।