বরিশাল মহানগর বিএনপি

এবার ‘সরোয়ারপন্থী’ ৩০টি ওয়ার্ড কমিটি বিলুপ্ত

বিএনপি
বিএনপি

বরিশাল মহানগর বিএনপির নতুন আহ্বায়ক কমিটি নিয়ে চলা দ্বন্দ্ব ও বিতর্কের মধ্যে এবার সিটি করপোরেশনের ৩০টি ওয়ার্ডের পূর্ণাঙ্গ কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার রাতে দলীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির এক জরুরি সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দলটির বরিশাল মহানগরের সদস্যসচিব মীর জাহিদুল কবির প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

দলীয় সূত্র জানায়, এই ৩০টি ওয়ার্ডের কমিটি নগর বিএনপির সাবেক সভাপতি ও কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ারের সময়ে করা। এসব কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকেরা সবাই তাঁর অনুসারী হিসেবে পরিচিত। গত নভেম্বরে তাঁরা বৈঠক করে নগর বিএনপির রাজনীতিতে সরোয়ারকে সমর্থন দিয়েছিলেন। দলটির কয়েকজন নেতা মনে করছেন, দলের ভেতরে সরোয়ারের শক্তি খর্ব করতেই এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব মীর জাহিদুল কবির অবশ্য বলেছেন, নগরের ৩০টি ওয়ার্ড কমিটির মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে অনেক আগেই। এগুলোর বেশির ভাগ নেতা সাংগঠনিকভাবে নিষ্ক্রিয়। অনেকে জীবিত নেই। তাই গতকাল রাতের সভায় সর্বসম্মতিক্রমে ৩০ ওয়ার্ড কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে।

গতকাল রাতের সভায় সভাপতিত্ব করেন দলের মহানগর কমিটির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান খান। এতে নগর কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক আলী হায়দার ছাড়াও সদস্য আলতাফ মাহমুদ সিকদার, হাবিবুর রহমান, শাহ আমিনুল ইসলাম, মাকসুদুর রহমান, সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল আলম ও সাইফুল আনাম উপস্থিত ছিলেন।

সভায় কমিটিগুলো ভেঙে দেওয়ার ঘটনাকে অগঠনতান্ত্রিক বলে উল্লেখ করেছেন এসব ওয়ার্ডের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকেরা। আজ শনিবার এ নিয়ে অন্তত ছয়জন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে কথা হয়। ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক মীর হাসান মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘১০ বছর ধরে আমরা আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে আছি। এখন আমাদের না ডেকে নিজেরা নিজেরা বৈঠক করে এভাবে কমিটি ভেঙে দিল, এটা বিএনপির গঠনতন্ত্র সম্মত নয়। বিষয়টি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়ও হয়নি।’

বরিশাল মহানগরের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ভেঙে দিয়ে গত বছরের ৩ নভেম্বর আহ্বায়ক কমিটির অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় বিএনপি। কমিটিতে মনিরুজ্জামান খানকে আহ্বায়ক, আলী হায়দারকে এক নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক ও মীর জাহিদুল কবিরকে সদস্যসচিব করা হয়। এরপর গত ২২ জানুয়ারি ৪১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটি অনুমোদন করা হয়। সেখানে আগের ১৭১ সদস্যের কমিটির গুরুত্বপূর্ণ নেতারা স্থান পাননি।

এর আগে পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটির জন্য কেন্দ্রে নাম জমা দেওয়ার পর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তা নিয়ে আপত্তি তোলেন মহানগরের আগের কমিটির অন্তত ৩১ নেতা। তাঁরা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। কিন্তু তাঁদের আবেদন আমলে নেওয়া হয়নি। লিখিত অভিযোগে নেতারা উল্লেখ করেছিলেন, পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটির অর্ধেকের বেশি নেতা ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর আর দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি। বর্তমান সরকারের শাসনকালে রাজপথে কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে তাঁরা অংশ নেননি। অনেকে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।

দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে মহানগর বিএনপির সভাপতি ছিলেন মজিবর রহমান সরোয়ার। সাংসদ, হুইপ ও সিটি করপোরেশনের মেয়রের দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। দলের সাংগঠনিক কাঠামোতে তাঁর শক্ত প্রভাব রয়েছে। সর্বশেষ ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে বিএনপির মহানগর কমিটি দেওয়া হয়, যার নেতৃত্ব পেয়েছিলেন সরোয়ার। দলীয় একাধিক সূত্রের দাবি, সরোয়ারের প্রভাব ঠেকাতে দীর্ঘদিনের নিষ্ক্রিয় অংশটি এবার আহ্বায়ক কমিটি করতে এককাট্টা হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁরা সফল হন।

এদিকে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি রাতে শহরের প্যারারা রোডে নগর বিএনপির সাবেক সহসাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল হকের ব্যক্তিগত কার্যালয়ে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেন আহ্বায়ক কমিটি থেকে বাদ পড়া নেতারা। এটাকে নগর বিএনপির রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের আভাস হিসেবে দেখছিলেন দলটির অনেক নেতা। এই গুঞ্জনের মধ্যেই গত শুক্রবার বিকেলে সরোয়ার আকস্মিকভাবে বরিশাল জেলা শ্রমিক দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বশির আহম্মেদের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে দোয়া মাহফিলে যোগ দেন। পরে তাঁকে সামনে নিয়ে কয়েক শ নেতা–কর্মী দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে ও চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে ঝটিকা মিছিল করেন। এর মধ্য দিয়ে অনেকটা প্রকাশ্যে আসে বিএনপির রাজনীতির ভেতরকার চাপা দ্বন্দ্বের বিষয়টি। এরপর শুক্রবার রাতে নগর বিএনপির ৩০টি ওয়ার্ড কমিটি ভেঙে দেওয়ার ঘটনা ঘটল।

মহানগরের বিলুপ্ত কমিটির সাবেক সহসাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির একটি গঠনতন্ত্র আছে। দল অবশ্যই সে অনুযায়ী চলার কথা। ৩০টি ওয়ার্ড কমিটির যে প্রক্রিয়ায় ভেঙে দেওয়া হলো, তা দলের গঠনতন্ত্র অনুসরণ করে হয়নি।

তবে মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব মীর জাহিদুল কবির বলেন, ‘যা হয়েছে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী হয়েছে। আমরা আগামী এক মাসের মধ্যে ওয়ার্ডগুলোতে কর্মিসভা করব। এসব সভায় সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করা হবে। সম্মেলনের মাধ্যমে ওয়ার্ড কমিটিগুলো গঠনের পর মহানগর বিএনপির সম্মেলন হবে।’

এ প্রসঙ্গে মজিবর রহমান সরোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সদ্যঘোষিত নগর কমিটিতে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের সঙ্গে দলের পরীক্ষিত নেতাদের কোনো বোঝাপড়া নেই। আমি বলব, এতে দল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যাঁরা বরিশালে দীর্ঘদিন শ্রম দিয়ে দলকে শক্তিশালী করেছেন, তাঁদের বাদ দেওয়ায় এটা একটা বাজে নজির স্থাপন হয়েছে। কেন্দ্রীয় কমিটির সমন্বয়হীনতার কারণে এটা হয়েছে।’

এতে দলে বিভাজন স্পষ্ট হলো কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি তো এখানে আর ফিরব না। তবে যাঁরা এত বছর হাল ধরে রেখেছেন, তাঁদের বাইরে রেখে কমিটি দিলে তো ক্ষোভ থেকেই যাবে।’

আর মহানগরের নতুন কমিটির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান খান বলেন, কারও ক্ষমতা খর্ব করার কিছু নেই। মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাওয়া ওয়ার্ডের কমিটিগুলো ভেঙে হয়েছে। এসব ওয়ার্ডে নতুন কমিটি করা হবে। মহানগরে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার প্রক্রিয়া হিসেবেই এটা করা হয়েছে।