এখানেই থামতে চায় না তারা

দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে সফল তারা, তবে এখানেই থামতে চায় না। এমন চার অদম্য মেধাবীর গল্প থাকছে আজ।

ঘরে খাবার না থাকায় উপোস থেকেই স্কুলে যেতে হয়েছে, পড়াশোনার খরচ জোগাতে করতে হয়েছে দিনমজুরি। এর মধ্যেও পড়াশোনা চালিয়েছে ওরা। এত সংকটের মধ্যেও এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ–৫ পেয়েছে তারা। ফলাফল প্রকাশের পর সহপাঠীরা যখন ভালো কলেজে ভর্তির জন্য দৌড়ঝাঁপ করছে, তখন এই অদম্য মেধাবীরা দুশ্চিন্তায় পড়েছে উচ্চমাধ্যমিকে পড়াশোনার খরচ জোগানো নিয়ে।

শ্রমিকের কাজ করেও সফল হরিদাস

ফল জানতে সহপাঠীরা যখন স্কুলে ছুটছে, মিষ্টি বিলাচ্ছে, হরিদাস রায় তখন রাজমিস্ত্রির সহকারীর (হেলপার) কাজে ব্যস্ত। সহপাঠীদের কাছে নিজের সাফল্যের খবর জানতে পেরে বাড়ি আসে হরিদাস। জিপিএ-৫ পাওয়ার কথা মাকে জানাতে গিয়ে চোখে পানি চলে আসে তার।

হরিদাস রায় পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার ময়নাপাড়া এলাকার অতুল রায়ের ছেলে। বাবা জীবিকার তাগিদে বিভিন্ন জেলায় কৃষিকাজ করে বেড়ায়। দুই ভাই-এক বোনের মধ্যে হরিদাস সবার বড়। হরিদাসের মা–ও দিনমজুরের কাজ করেন। পড়াশোনার ফাঁকে হরিদাস কখনো রাজমিস্ত্রির কাজ আবার কখনো কাজ করে ইটভাটায়।

পিইসি ও জেএসসিতেও জিপিএ-৫ পাওয়া হরিদাস রায় বলে, ‘ছোটবেলা থেকেই আমার ইচ্ছা ইঞ্জিনিয়ার হব। কিন্তু ভালো ফল করেও টাকার অভাবে বাইরের কোনো ভালো কলেজে ভর্তি চয়েজ (পছন্দ) দিতে পারিনি। অবশেষে দেবীগঞ্জ সরকারি কলেজে ভর্তি হয়েছি। এখানে পড়ালেখার খরচ কীভাবে জোগাড় করব, সেই দুশ্চিন্তায় আছি।’

সব পরীক্ষায় সব বিষয়ে জিপিএ–৫ তাজরিনের

দিনমজুর বাবা কাজে গেলে দুই বেলা পেটে খাবার জোটে। কাজ না পেলে খেয়ে না খেয়ে কোনোরকমে দিন কাটাতে হয়। এত দারিদ্র্যের মধ্যেও তাজরিন আক্তার হার মানেনি। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সব বিষয়ে জিপিএ–৫ পেয়েছে সে। এর আগে পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষায়ও সব বিষয়ে জিপিএ–৫ ছিল তার।

সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার মহদীপুর গ্রামের আবদুল ওয়াদুদ ও মনোয়ারা বেগম দম্পতির মেয়ে তাজরিন। তিন বোনের মধ্যে সবার বড় তাজরিন।

মনোয়ার বেগম বলেন, ‘আমরার স্বপ্ন তাজরিন লেহাপড়া কইয়া ডাক্তার অইতো। স্কুলের স্যারেরা সহায়তায় হে এই পর্যন্ত আইছে। হে ময়মনসিংহ সরকারি কলেজে চান্স পাইছিল। হেন রাইখ্যা হেরে হরাইতাম হারতামনা (পড়াতে পারব না) দেইখ্যা হেই চিন্তা বাদ দিছি। সাইনসে পড়লে বই কিনতে ও ভর্তি করতে মেলা টেহা লাগব। এত টেহা ফাইয়াম কই।’

ফলাফলের পর থেকেই দুশ্চিন্তায় সুরাইয়া

এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর যখন অন্যরা ভালো কলেজে পড়ালেখা করার ভাবনায় মশগুল, তখন সুরাইয়া আক্তার অস্থির পড়াশোনার খরচ জোগানোর চিন্তায়। সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার ধানগড়া ইউনিয়নের কাজিপুর গ্রামের প্রান্তিক কৃষক আয়ুব আলী ও গৃহিণী মিনতি খাতুনের বড় মেয়ে সে। পড়ালেখায় ভালো সুরাইয়া এবারের এসএসসি পরীক্ষায় মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে।

ফলাফল প্রকাশের পর পরিবারের একটাই দুশ্চিন্তা, তার উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে পড়ালেখার খরচ কীভাবে জোগাবে তারা। তার বাবা আয়ুব আলী বলেন, ‘অন্যের জমিতে চাষাবাদ করি। অন্য সময় দিনমজুরি করতে হয়। মেয়েটির পড়ালেখার জন্য কেউ সহায়তা করলে খুব উপকার হয়।’

জেকে আবদুল মান্নান উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আবদুল মান্নান সরকার বলেন, ‘মেধাবী ছাত্রীটির উচ্চমাধ্যমিক স্তরের পড়ালেখা করার জন্য সহৃদয় মানুষ পাশে দাঁড়াবেন বলে আশা করি।’

‘উপাস থাকিও ছাওয়াটা স্কুল গেইছে’

পাঁচ বছর বয়সে রনি মিয়ার বাবা মারা যান। এরপর মা ও ছোট ভাইয়ের সঙ্গে তার ঠাঁই হয় নানাবাড়িতে। তৃতীয় শ্রেণিতে উঠতেই দিনমজুর নানাও মারা যান। সংসারের হাল ধরেন মা নূরনাহার বেগম। হাঁস-মুরগি পালন আর অন্যের বাড়িতে কাজ করে পাঁচ সদস্যের সংসার চালান তিনি। পড়াশোনার খরচ জোগাতে দিনমজুরি শুরু করে রনি মিয়া। পরিশ্রমের ফলও পেয়েছে সে, এবারের এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ–৫ পেয়েছে।

রনির বাড়ি রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার কিসামত মেনানগর কাচারীপাড়া গ্রামে।

নূরনাহার বেগম বলেন, ‘বেটাটাক (ছেলেটি) পেট ভরে দুই বেলা খাবার দিবার পাও নাই। উপাস থাকিও মেলাদিন ছাওয়াটা স্কুল গেইছে।’ এরপর আর কিছু বলতে পারছিলেন না নূরনাহার। শুধুই কাঁদছিলেন। ছেলের জিপিএ-৫ লাভের অর্থ কী, তা বোঝেন না নূরনাহার। তবে ছেলেকে চিকিৎসক বানাতে চান তিনি। রনিও চায় মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে।

ডাংগীরহাট স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ রফিকুল ইসলাম বলেন, কারও সহযোগিতা পেলে ছেলেটি বহুদূর যেতে পারবে।


[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন রাজিউর রহমান, পঞ্চগড়, সালেহ আহমদ, ধর্মপাশা, সুনামগঞ্জ, সাজেদুল আলম, রায়গঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, রহিদুল মিয়া, তারাগঞ্জ, রংপুর]