এক যুগ ধরে শিকলে বাঁধা জীবন

ঘরে লোহার শিকলে বাঁধা মানসিক প্রতিবন্ধী শাহজালাল
 আবু তাহের

দুই পায়ে পরানো হয়েছে লোহার চাকতি লাগানো শিকল। আর দুই হাত শিকলে বেঁধে দেওয়া হয়েছে তালা। ছয় ফুট দৈর্ঘ্য ও চার ফুট প্রস্থের ছোট একটি ছাপরাঘরে কাটছে তাঁর জীবন। এভাবেই কেটে গেছে তাঁর এক যুগ। শিকলবন্দী ওই ব্যক্তির নাম মো. শাহজালাল (৪০)। তিনি একজন মানসিক প্রতিবন্ধী।

ফেনীর দাগনভূঁইয়া উপজেলার মাতুভূঁইয়া ইউনিয়নের মোমারিজপুর গ্রামের আবদুল হকের ছেলে শাহজালাল। ফেনী শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে সম্প্রতি গ্রামের ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ভাঙা বাঁশের বেড়া ও টিনের ছাউনি দেওয়া ঘরে শিকলবন্দী অবস্থায় বসে আছেন শাহজালাল। ঘরে আছে একটি চৌকি ও একটি চেয়ার। চৌকির ওপর ছেঁড়া ও আধা ভেজা কাঁথায় জড়সড় হয়ে বসে ছিলেন তিনি। তাঁর পরনে ছিল ছেঁড়া ময়লা শার্ট ও লুঙ্গি। ঘরে কেউ ঢুকলে তাঁর নাকে লাগবে দুর্গন্ধ। শাহজালালকে প্রস্রাব-পায়খানা সারতে হয় ঘরের পাশেই। চেয়ারে রাখা ছেঁড়া ও ময়লা কাঁথা দুর্গন্ধে ভরা। কেউ তাঁকে খাবার খাইয়ে দিলে তাঁর ক্ষুধা মেটে, নতুবা থাকতে হয় উপোস।

এই ছাপরাঘরে শিকলবন্দী জীবন কাটান শাহজালাল।

শাহজালালের বৃদ্ধ মা আনোয়ারা বেগম জানান, পাঁচ ছেলে ও চার মেয়ের মধ্যে শাহজালাল সবার ছোট। ১২-১৩ বছর আগে চট্টগ্রামে আবুল খায়ের কোম্পানির একটি কারখানায় কাজ করতেন শাহজালাল। চাকরি করার সময় তিনি একদিন জ্বরে আক্রান্ত হন। তাঁর চিকিৎসা করা হচ্ছিল। এরপর ধীরে ধীরে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারাতে শুরু করেন। স্থানীয় পল্লিচিকিৎসক ও কবিরাজ দিয়েও তাঁর চিকিৎসা করা হয়।

একপর্যায়ে শাহজালালের মানসিক ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের কাছে পেলেই তাঁদের মারধর শুরু করেন। আর ঘরের জিনিসপত্র ভাঙচুর শুরু করেন। আশপাশের বাড়ির মানুষের ওপরও হামলে পড়েন তিনি। এরপর থেকে বাধ্য হয়ে বাড়ির লোকজন শাহজালালের হাতে-পায়ে শিকল পরিয়ে আটকে রাখেন।

শাহজালালের স্কুলপড়ুয়া ভাতিজা জাহিদুল ইসলাম নাঈম বলে, দীর্ঘ ১২-১৩ বছর ধরে তার চাচা অসুস্থ। তিনি কারও সঙ্গে কথা বলেন না। মানুষ দেখলেই এটা–সেটা ছুড়ে মারেন। এ জন্য তাদের ঘরের পাশে আলাদা একটি ছাপরাঘর তৈরি করে সেখানে তাঁকে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে।

শাহজালালের চাচাতো ভাই শাহাদাত হোসেন বলেন, চট্টগ্রামে একই প্রতিষ্ঠানে শাহজালালের সঙ্গে তিনিও চাকরি করতেন। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার পর থেকে তিনি (শাহাদাত) তাঁকে খাইয়ে দেন ও দেখভাল করেন। তিনি না খাইয়ে দিলে অন্য কারও হাতে শাহজালাল ভাত খান না। দু–তিন দিন পরপর তাঁকে গোসল করিয়ে দেওয়া হয়।

মানসিক ভারসাম্যহীন শাহজালালের পরিবারটি হতদরিদ্র উল্লেখ করে প্রতিবেশী ও সমাজসেবাকর্মী আজিম ছিদ্দিকী বলেন, শাহজালালের অন্য ভাইয়েরা বিয়ে করে আলাদা সংসার নিয়ে ব্যস্ত। কেউই তাঁর খবর নেন না। অর্থের অভাবে গত প্রায় এক যুগ তাঁর চিকিৎসা কারানো হয়নি। চিকিৎসা করানো হলে হয়তো তিনি সুস্থ হয়ে উঠতেন।

লোহার শিকলে বাঁধা অবস্থায় ঘরে বসে আছেন তিনি

শাহজালালের মানসিক ভারসাম্যহীনতার বিষয়টি জানার পর কয়েক বছর আগে তাঁর জন্য একটি প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড করে দিয়েছেন স্থানীয় মাতুভূঁইয়া ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের (মোমারিজপুর) সদস্য ফারুকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ওই কার্ডে প্রতি মাসে ৭০০ টাকা ভাতা পান শাহজালাল। সেই টাকা দিয়ে তাঁর খাবার জোগাড় করে পরিবার। এ ছাড়া করোনাকালে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তাঁকে কিছু সহায়তা করা হয়েছিল।

দাগনভূঁইয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রবিউল হাসান বলেন, শাহজালালের শিকলবন্দী জীবনের কথা সম্প্রতি তিনি জেনেছেন। মঙ্গলবার বিকেলে তিনি ওই বাড়ি পরিদর্শন করেন। তাঁর চিকিৎসার বিষয়টি নিশ্চিত করার চেষ্টা করবেন তিনি। প্রয়োজনে আর্থিক সহায়তার খাত খুঁজে বের করে তাঁকে সহায়তার ব্যবস্থা করবেন ইউএনও।