এক পাশে বালাইনাশক, অন্য পাশে বই

বিজয় কুমার পালের (বাঁয়ে) বালাইনাশকের দোকানে বইয়ের বিরাট সংগ্রহ। বিরামপুরের গোলাপগঞ্জ বাজারে। ছবি: প্রথম আলো
বিজয় কুমার পালের (বাঁয়ে) বালাইনাশকের দোকানে বইয়ের বিরাট সংগ্রহ। বিরামপুরের গোলাপগঞ্জ বাজারে।  ছবি: প্রথম আলো

বালাইনাশকের দোকান। ঢুকলেই নাকে লাগবে ঝাঁজালো গন্ধ। লম্বা সময় এমন দোকানে বসে থাকা দায়। ক্রেতারা কাজ সেরে চলে গেলেও দোকানি বিজয় কুমার পালকে তো সারা দিন বসেই থাকতে হয়। তবে তিনি সেখানে আরও একধরনের গন্ধ যুক্ত করেছেন। বইয়ের গন্ধ। আর সেটা তাঁকে দিয়েছে ভিন্ন পরিচয়।

হ্যাঁ, দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার গোলাপগঞ্জ বাজারে বালাইনাশকের পাইকারি বিক্রেতা বিজয় ট্রেডার্সে গেলে বালাইনাশকের পাশাপাশি চোখে পড়বে থরে থরে বই। কিন্তু সেখানে বালাইনাশক বিক্রি হলেও বই বিক্রি হয় না। বালাইনাশক কিনতে গেলে দোকানমালিক কথা বলার ফাঁকে আপনাকে বই পড়তে উৎসাহিত করবেন। পড়ার জন্য দিতে চাইবেন বই। গল্প, কবিতা, উপন্যাসসহ বিভিন্ন ধরনের ৬ হাজার ২০০ বই আছে তাঁর সংগ্রহে।

বিজয় কুমার পাল নবাবগঞ্জের শালবাগান মহল্লার মৃত বিমল চন্দ্র পালের ছোট ছেলে। বিজয় জানান, ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তিন গোয়েন্দা দিয়ে তাঁর বই পড়া শুরু। এরপর মাসুদ রানা সিরিজ। দশম শ্রেণিতে উঠে শুরু হয় হুমায়ূন আহমেদ, জাফর ইকবালের বই পড়া। ২০০১ সালে বাণিজ্য বিভাগে এসএসসি পাস করেন বিজয়। কলেজ শেষ করে ব্যবসায় ঢুকে পড়েন, কিন্তু বই পড়া ছাড়েননি। পড়ে চলছেন মনের আনন্দে। অন্যরাও যাতে বই পড়ে, সে চেষ্টাও করছেন।

বিজয় জানান, এখানকার সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার প্রায় ৫০ জন আছেন তাঁর নিয়মিত পাঠক। নবাবগঞ্জ উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মল্লিকা সেহানবীশ, নবাবগঞ্জ আলিম মাদ্রাসার শিক্ষক আবু বক্কর সিদ্দিক, শিমুলতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মৌসুমী আক্তার, দাউদপুর বাজারের শিক্ষার্থী শুভ কুমার দাস, মঙ্গলপুর বাজারের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী তানভীর হোসেন, চাকরিজীবী নুর আলম তাঁদের অন্যতম। বিভিন্ন পাঠকের কাছে বিজয়ের শতাধিক বই আছে এই মুহূর্তে। পড়া শেষ হলে বই জমা দিয়ে অন্য বই নিয়ে যান তাঁরা।

বিজয়ের কাছ থেকে নিয়মিত বই নিয়ে পড়েন গোলাপগঞ্জ বাজারের টেলিভিশন মেকার আবদুল গাফ্ফার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাঁর কাছ থেকে বই নিয়ে পড়ি। কাজের ফাঁকে বা কাজের বাইরে বই পড়ে আনন্দ পাই।’

বিজয় কুমার জানান, প্রথমে তাঁদের দোকান ছিল বিরামপুরে। ২০০১ সালে এসএসসি পাস করার পর নবাবগঞ্জের গোলাপগঞ্জ বাজারে ভাড়া দোকানে নতুন ব্যবসা শুরু হয় তাঁদের। বিরামপুর সরকারি কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হন বিজয়। পড়াশোনার পাশাপাশি গোলাপগঞ্জের নতুন দোকানে বসা শুরু করেন বিজয়।

দোকানে বসে বিজয় বুঝতে পারেন, বালাইনাশক ব্যবসা মূলত মৌসুমি ব্যবসা। বছরে দুই মৌসুমে মোট ছয় মাস বেচাকেনা হয়। বাকি ছয় মাস প্রায় বসেই কাটাতে হয়। যে ছয় মাস বেচাকেনা হয়, তখনো অনেক অলস সময় থাকে। তাই দোকানে বসে শুরু হয় বিজয়ের বই পড়া। নিজে বই পড়তে পড়তে দোকানে জমা হতে থাকে বই। একটা সময় এমন অবস্থা দাঁড়ায়, বই রাখার জায়গার অভাব দেখা দেয়। বড় পরিসরে দোকান করার সিদ্ধান্ত নেন বিজয়। ২০১৫ সালে বাজারের পশ্চিম পাশে জায়গা কিনে বড় পরিসরে নতুন দোকান করেন। সেই দোকানের এক পাশে বই রাখার জন্য একটি আলাদা কক্ষ তৈরি করেন।

বিরামপুর থেকে নবাবগঞ্জে যাওয়ার পথে পাঁচ কিলোমিটার দূরে গোলাপগঞ্জ বাজার। দোকানে ঢুকেই চোখে পড়বে ছোট-বড় চারটি শেলফ। সামনে টেবিলে বিজয় বসা। তাঁর ঠিক পেছনের দুটি শেলফ বইয়ে সাজানো। অন্য দুটিতে বিভিন্ন ধরনের বালাইনাশক। বই পড়া এবং রাখার জন্য দোকানের একাংশে রয়েছে আলাদা কক্ষ। সেই কক্ষেÿকয়েকটি শেলফে থরে থরে বই রাখা। আছে একটি ছোট্ট খাটও। খাটেও বইয়ের স্তূপ। মাঝেমধ্যে এখানে শুয়ে বই পড়েন বিজয়। আর আছে একটি স্টিলের ট্রাংক, তাতে রয়েছে পুরোনো বই।

বিজয় পাল জানান, তাঁর সংগ্রহে হুমায়ূন আহমেদ, জাফর ইকবাল, আনিসুল হক, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, নীহাররঞ্জন গুপ্ত, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নারায়ণ সান্যাল, প্রফুল্ল রায়, বিমল মিত্র, সমরেশ মজুমদার, ভগীরথ মিশ্র, গজেন্দ্র কুমার মিত্র, হেমেন্দ্র কুমার রায়, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের সব বই রয়েছে। অনুবাদ সাহিত্যসহ বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন লেখকের ৬ হাজার ২৩৪টি বইয়ের সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছেন তিনি।

প্রথমে বিজয় বই সংগ্রহ শুরু করেন বিরামপুরের আইডিয়াল লাইব্রেরি থেকে। আইডিয়াল লাইব্রেরির স্বত্বাধিকারী আমিনুল ইসলাম বই সংগ্রহে অনুপ্রেরণা ও সার্বিক সহযোগিতা করে গেছেন। পরে ঢাকার প্রকৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী সৈকত হাবিব এবং অনলাইন বই বিক্রির সাইট বুক স্ট্রিটের স্বত্বাধিকারী সৈয়দ মো. রেজওয়ানের সঙ্গে পরিচয় হয় বিজয়ের। তাঁরাও তাঁকে বই সংগ্রহে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন।

নিজে বই পড়েন, অন্যকেও পড়তে উৎসাহিত করেন বিজয়। পরিচিত ব্যবসায়ী, ক্রেতা ও এলাকার তরুণদের বই পড়তে দেন তিনি। তবে তাঁর আক্ষেপ, তরুণদের মধ্যে এখন মুঠোফোনের আসক্তি খুব বেশি। এরা বই থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তিনি জানান, ২০০১ সালের দিকে গোলাপগঞ্জ বাজারে প্রথম যখন আসেন, তখন এলাকার অনেক তরুণ, স্কুলের শিক্ষার্থী বিজয়ের কাছ থেকে নিয়মিত বই নিয়ে পড়ত। এখন সে হার একেবারেই কম। স্কুলের কিছু ছাত্রী বিজয়ের কাছ থেকে বই নিয়ে পড়ত। কিন্তু এলাকার কিছু বখাটে বিজয়কে ফাঁসাতে ষড়যন্ত্র শুরু করে। বিষয়টি বুঝতে পেরে বাধ্য হয়ে ছাত্রীদের বই দেওয়া বন্ধ করেন তিনি।

বিজয় এখন পড়ছেন মোগল সিংহাসনের দখল নিয়ে লেখা শাহীন আখতারের ময়ূর সিংহাসন বইটি। তিনি বলেন, মানুষ সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন কাটানোর জন্য পরিশ্রম করে। কিন্তু খুব কম লোকেই কাঙ্ক্ষিত সুখ বা আনন্দ পায়। কিন্তু একটা ভালো বই পড়লে যে কেউ সহজে আনন্দ পেতে পারেন। একটা ভালো বইয়ের পেছনে যে অর্থ ব্যয় হয়, তার চেয়ে বেশি প্রতিদান পাওয়া যায়।

আইডিয়াল লাইব্রেরির স্বত্বাধিকারী আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ছোটবেলা থেকেই বিজয় বইয়ের প্রতি অনুরক্ত। তাঁর লাইব্রেরির নিয়মিত গ্রাহক বিজয়। তিনি বলেন, দিন দিন যেখানে বই পড়া মানুষের সংখ্যা কমছে, সেখানে স্রোতের বিপরীতে বই হাতে দাঁড়িয়ে আছেন বিজয়।

স্ত্রী পলি রানী পাল এবং একমাত্র মেয়ে বিত্তামনি পালকে (৪) নিয়ে বিজয়ের ছোট সংসার। পলি পাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বইয়ে ভর্তি আমাদের শোবার ঘরও। স্বামীর অভ্যাসের কারণে আমিও আস্তে আস্তে বই পড়ায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। বই আমাদের সংসারের একটা অংশ।’

স্থানীয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নবাবগঞ্জ মহিলা ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক শাফিকুল ইসলাম বলেন, সমাজে জ্ঞানের আলো জিইয়ে রাখতে বই পড়ার বিকল্প নেই। স্রোতের বিপরীতে বিজয়ের এই উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মশিউর রহমান ও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবু রেজা মো. আসাদুজ্জামানের মতে, একজন ব্যবসায়ী শুধু যে মুনাফাই করবেন তা নয়, তিনি চাইলে ব্যক্তি ও সমাজে পরিবর্তনও আনতে পারেন। বিজয় যেন সেটাই বলছেন তাঁর কাজের মাধ্যমে।