দীর্ঘদিন ধরে চাষ করা জমির মালিকানা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন কৃষকেরা। সরেজমিনে গেলে তাঁরা কথা বলেন প্রতিবেদকের সঙ্গে। ১২ জানুয়ারি শিবগঞ্জের ঘোড়াপাখিয়া মৌজায়
দীর্ঘদিন ধরে চাষ করা জমির মালিকানা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন কৃষকেরা। সরেজমিনে গেলে তাঁরা কথা বলেন প্রতিবেদকের সঙ্গে। ১২ জানুয়ারি শিবগঞ্জের ঘোড়াপাখিয়া মৌজায়

শিবগঞ্জে ভূমি জরিপ

‘এক টুকরো কাগজের’ জন্য, জমিটা যায় যায়

পদ্মায় বিলীন হওয়া জমি জেগে ওঠার পর জরিপ কার্যক্রম চলছে। খাজনার রসিদ না থাকা কৃষকেরা জমির মালিকানা পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় আছেন।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের ঘোড়াপাখিয়া মৌজায় পদ্মার চরের জমিতে এখন ফসলের সমারোহ। একটি জমি থেকে পেঁয়াজ তুলছিলেন কৃষক আবু বক্কর (৫৮)। তাঁর জমিটি দুই বছর আগে নদীতে বিলীন হওয়ার পর আবার জেগে উঠেছে। এখন এই জমির মালিকানা তাঁর থাকবে কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন।

নিয়ম অনুযায়ী নদীতে বিলীন হওয়া জমি শিকস্তি হয়ে যায়। পরে তা জেগে উঠলে পয়স্তি হিসেবে সরকারের খাস খতিয়ানভুক্ত হয়। জমির মালিকানা ফিরে পেতে তখন বন্দোবস্ত নিতে হয়। জমা দিতে হয় খাজনার রসিদ। চাঁপাইনবাবগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মহসীন মৃধা বলেন, নদীভাঙনে বিলীন হওয়ার পর জরিপে তা চিহ্নিত করা হয়। ৩০ বছরের মধ্যে এসব জমি জেগে উঠলে সরকারের কাছে পত্তনি (বন্দোবস্ত) নিতে হয়।

কৃষক আবু বক্কর বলেন, ‘বাপ-দাদার জমি। দুই বচ্ছরের মোদধেই লোদ্দি (নদী) থ্যাকা উঠ্যাছে। এখন শুনছি খাস হয়্যা গেছে। এগল্যা কৃষকমারা আইন লিয়া খুব জ্বালাতে আছি।’

আবু বক্কর আরও বলেন, পারিবারিক সূত্রে জমিটিতে তিনি প্রায় ২০ বছর ধরে চাষ করেন। জমি শিকস্তির সময় কোনো খাজনা নেওয়া হয়নি। এখন খাজনার রসিদও তাঁর কাছে নেই। জেগে ওঠার পর ভূমি জরিপকারীরা বলেছেন, জমিটি খাস খতিয়ানভুক্ত হয়েছে। এখন খাজনার রসিদ দেখাতে না পারলে এটি আর তাঁর (আবু বক্কর) নামে রেকর্ড হবে না।

শিবগঞ্জ উপজেলার ঘোড়াপাখিয়া ইউপির ঘোড়াপাখিয়া মৌজায় একসময় পদ্মা নদীতে বিলীন হয়ে জেগে ওঠা জমির ডিজিটাল দিয়ারা জরিপ চলছে। জমির মালিকানা বা সীমানা চিহ্নিত করতে কাজ করছে ভূমি জরিপ বিভাগ। তবে জরিপ নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকার কথা জানিয়েছেন এই মৌজায় চাষাবাদ করা কৃষকেরা।

ঘোড়াপাখিয়া মৌজায় জমি আছে, এমন আরেক কৃষক পিয়ার আলী। ১২ জানুয়ারি সরেজমিনে গেলে পিয়ার আলী মাটিতে একটি বাঁশের থোপ দেখান। এরপর বলেন, ‘লোদ্দির পানি ন্যামা যাওয়ার পরেই বাপে বাঁশ লাগিয়্যা গেছে। এখুন যুদিল (যদি) কেহু (কেউ) কহে (বলে) এ থোপ তোমারঘে লয়, সরকারের তেবে (তবে) মনে কী কহে কহেন তো। এক টুকরা কাগজের (খাজনার রসিদ) জন্য হামরা তো জান গেলেও বাপ-দাদার এ জমির মালিকানা ছাড়ব না।’

সম্প্রতি ঘোড়াপাখিয়া মৌজায় কথা হয় মো. জামাল, হযরত আলী, আহসান আলী, মসিদুল হক, লিয়াকত আলীসহ আরও কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে। তাঁদের ভাষ্য, এ মৌজায় জমি আছে, এমন কয়েকজন খাজনা দিচ্ছেন। অনেকের কাছে থেকেই খাজনা নেওয়া হচ্ছে না। দিয়ারা জরিপকারী দলের লোকজন বলছেন, যার নামে খাজনা দেওয়ার রসিদ থাকবে তাঁর নামে জমি রেকর্ড হবে। বাকি জমি সরকারের খাস খতিয়ানে উঠবে।

ভূমি জরিপকারীদের বিরুদ্ধে কৃষকদের অভিযোগ সীমানা চিহ্নিত করা নিয়ে। জামাল, হযরত, আহসান নামের ওই কৃষকেরা বলেন, ২০২০ সালের দিকে জরিপ শুরু হয়। মাঝে করোনা পরিস্থিতির কারণে বন্ধ থাকে। এরপর আবারও জরিপের কাজ শুরু হয়েছে। প্রথমে জরিপকারী দলের সদস্যরা জমি চিহ্নিতের সময় অনেকের কাছে থেকে টাকা নিয়েছেন। নতুন করে আরেক দল এসে বলছে আবারও টাকা দিতে হবে। এ নিয়ে কৃষকেরা বিপাকে পড়েছেন।

জরিপ বিভাগের রাজশাহী অঞ্চলের প্রধান (দিয়ারা অপারেশন) ফজলুল করিম বলেন, যার জমি তিনি আইল (সীমানা) ঠিক রাখবেন। যাঁর কাগজ আছে, তাঁর নামে রেকর্ড হবে। কোনো টাকা লাগবে না।

কারও কাছে থেকে জমির খাজনা নেওয়া বা না নেওয়া প্রসঙ্গে ঘোড়াপাখিয়া ইউনিয়নের ভূমি কর্মকর্তা (তহশিলদার) আবদুল হামিদ বলেন, জমি পয়স্তি হওয়ার পর অর্থাৎ জেগে ওঠার পর খাজনা চালুর জন্য জমির মালিকদের জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করতে হতো। কিন্তু কেউ কেউ তা করেননি। এ ক্ষেত্রে তহশিলদারের কিছু করার নেই।