উয়ারী-বটেশ্বরের ‘গঙ্গাঋদ্ধি জাদুঘর’ নির্মাণে জটিলতা

দুই দফা প্রকল্পের মেয়াদ পেরিয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত মাত্র ৩৫ ভাগ কাজ হয়েছে। নকশা জটিলতায় এখন কাজ বন্ধ

নরসিংদী জেলার মানচিত্র

আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন দুর্গনগরী নরসিংদীর উয়ারী-বটেশ্বর। এই নগরীর প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্বের দিকটি গবেষকদের নজরে আনতে কৈশোর থেকে বিরামহীন লড়াই করে চলেছেন মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ পাঠান। এই প্রত্ন-সংগ্রাহকের বাড়ি বটেশ্বর গ্রামে। তিনি এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। তাঁর আফসোস এই অঞ্চলে নির্মাণাধীন ‘গঙ্গাঋদ্ধি জাদুঘর’–এর কাজের গতি, মান ও সৃষ্ট জটিলতা নিয়ে।

স্থানীয় ব্যক্তিরা জানালেন, উয়ারী-বটেশ্বর থেকে পাওয়া প্রত্নসামগ্রী সংরক্ষণ এবং জনপদটির নানা ঐতিহাসিক নিদর্শন প্রদর্শন করতে ‘গঙ্গাঋদ্ধি জাদুঘর’ নামে একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় সরকার। দেড় বছর আগেই কাজ শেষ হওয়ার কথা। এর মধ্যে মাত্র এক–তৃতীয়াংশ কাজ এগিয়েছে। প্রকল্পের নানা অসংগতির কারণে ছয় মাস ধরে কাজ বন্ধ। ফলে জীবদ্দশায় পূর্ণাঙ্গ জাদুঘরটি দেখে যাওয়ার ব্যাপারে সন্দিহান হাবিবুল্লাহ পাঠান।

দুর্গনগরী উয়ারী-বটেশ্বরের অবস্থান নরসিংদীর বেলাব উপজেলার উয়ারী এবং বটেশ্বর গ্রামে। দিন দিন দেশ-বিদেশে প্রত্ন অঞ্চলটির গুরুত্ব বাড়ছে, বিশেষ করে ২০০০ সাল থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে প্রতিবছর সেখানে খননকাজ হওয়ার কারণে জনপদটির আন্তর্জাতিক গুরুত্ব বাড়ে। এরই মধ্যে আবিষ্কৃত হয়েছে ইটের স্থাপত্য, অসম রাজার গড়, আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন নগরের সমসাময়িক মানব বসতির ৬০০ মিটার বিস্তৃত দুর্গ এলাকা, প্রশস্ত রাস্তা, পার্শ্ব রাস্তা, দুর্গ প্রাচীর, পরিখা, লৌহনির্মিত হস্ত-কুঠির, বল্লম, তাবিজ, ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রা, কাচের পুঁথি, বাটখারা, গর্তনিবাস, ধাতব চুড়ি বা তাম্র বালাই, পোড়া মাটির চাকতি, বৌদ্ধ পদ্ম মন্দিরসহ আরও কিছু প্রত্নসামগ্রী।

২০১৯ সালের ২৯ নভেম্বর জাদুঘর নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন। কাজটি হচ্ছে নরসিংদী জেলা পরিষদের অর্থায়নে। প্রকল্পে ১৬ হাজার বর্গফুট জায়গা নেওয়া হয়েছে। ভবনটি হবে তিনতলা। প্রথম ও দ্বিতীয় তলা হবে গ্যালারি। তৃতীয় তলায় গ্যালারির পাশাপাশি থাকবে গবেষকদের থাকার কক্ষ। প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে ৭ কোটি ৬৯ লাখ ৩৭ হাজার ২৪৩ টাকা। কাজ শেষ করে আনার সময় এক বছর। গেল বছরের নভেম্বর মাসে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়। পরে মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২১ সালের মে মাস করা হয়। এরই মধ্যে মে মাসও শেষ হয়ে গেছে। এই সময়ের মধ্যে মাত্র এক–তৃতীয়াংশ কাজ হয়েছে। কাজটি করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আরসিসি আরআই জেবি নামে একটি প্রতিষ্ঠান।

প্রকল্পটির নকশা ও ব্যয় নির্ধারণ করার জন্য জেলা পরিষদ দায়িত্ব দেয় ‘বাসাবাড়ি ফার্ম’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে। প্রকল্পের সার্বিক দেখভালের দায়িত্বও একই প্রতিষ্ঠানের। গত ১৯ জুন সরেজমিনে দেখা যায়, কাজ বন্ধ। মাত্র একটি ভবনের ছাদ ঢালাই হয়েছে। অন্যস্থানে কেবল বিম ওঠানো।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারীদের একজন তপন কুমার পাল। তিনি বলেন, ‘চুক্তির সঙ্গে প্রায়োগিক কাজের মিল নেই। এইভাবে কাজটি করতে গিয়ে আমার লোকসান হয়ে যাবে। আবার এই সব ছাড়া কাজ এগিয়ে নিতেও দিচ্ছেন না খননকাজে থাকা গবেষকেরা।’ তাঁর দাবি, এখন পর্যন্ত কাজ হয়েছে ৩৫ ভাগ।

সৃষ্ট জটিলতার জন্য খননকাজে নেতৃত্বে থাকা সুফি মোস্তাফিজুর রহমানও বাসাবাড়ি ফার্মকে দায়ী করছেন। তিনি বলেন, নকশা করতে গিয়ে ‘বাসাবাড়ি’ এমনিতেই দীর্ঘ সময় নিয়েছে। নকশায় তিনতলা ধরা হয়েছে। এর জন্য ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে এবং ঠিকাদার কাজও বুঝে নিয়েছেন। এরপর যদি কোনো কারণে একই অর্থ দিয়ে সেই ভবন দোতলা হয়, তাহলে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ, তিনতলায় প্রদর্শনীর পাশাপাশি গবেষকদের আবাসন ব্যবস্থা রাখা। গবেষকদের থাকা নিশ্চিত করা না গেলে গবেষণা এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, একটি স্কুলঘরে দীর্ঘদিন খড় বিছিয়ে থেকে তাঁরা গবেষণা করেছেন। এখন ওই স্কুল থেকেও বের করে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং তিনতলা নির্মাণ ছাড়া বিকল্প নেই।

বাসাবাড়ি ফার্মের স্বত্বাধিকারী অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন জানালেন, নকশা ও ব্যয় নির্ধারণ কাজটি তিনি স্বস্তিতে করতে পারেননি। নকশা করার সময় বিশেষ করে সুফি মোস্তাফিজুর রহমান নানা বিষয় সংযোজন-বিয়োজন করতে বলেন। ফলে কিছু সমস্যা হয়ে গেছে। পরে নতুন করে রিভিউ করে দিয়েছেন। চাইলে আবারও দিতে রাজি আছেন।

জাদুঘরটির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানতে চাইলে জেলা পরিষদের সহকারী প্রকৌশলী নুরুল আলম চৌধুরী বলেন, বরাদ্দকৃত টাকা বাড়ানোর সুযোগ নেই। এই টাকায় যতটুকু হয়, ততটুকুই করতে হবে। অর্থাৎ দোতলা হলে দোতলা, না হলে আড়াইতলা নির্মাণ করা হবে।